পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/১৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিত্তশুদ্ধি S9 0 পারিয়াছে। বিশ্বামিত্র বা পরাশর ইন্দ্ৰিয় জয় করিতে পারেন নাই। ভীষ্ম বা লক্ষ্মণ পারিয়াছিলেন। হিন্দুধৰ্ম্মের এই একটি অতি নিগৃঢ় কথা কহিলাম। কিন্তু ইন্দ্ৰিয়সংযম অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ কথা। চিত্তশুদ্ধির তাহার অপেক্ষা গুরুতর লক্ষণ আছে। অনেকের ইন্দ্ৰিয় সংযত, কিন্তু অন্য কারণে র্তাহাদিগের চিত্ত শুদ্ধ নয় । ইন্দ্ৰিয়সুখ ভোগ করিব না, কিন্তু আমি ভাল থাকিব, আমারগুলি ভাল থাকিবে, এই বাসনা তাহদের মনে বড় প্রবল। আমার ধন হউক, আমার মান হউক, আমার সম্পদ হউক, আমার যশ হউক, আমার সৌভাগ্য হউক, আমি বড় হই, আর সবাই আমার অপেক্ষা ছোট হউক, তঁহার এইরাপ কামনা করেন । এই সকল অভীষ্ট যাহাতে সিদ্ধ হয়, চিরকাল অনুদিন সেই চেষ্টায়, সেই উদ্যোগে ব্যস্ত থাকেন। সে জন্য না করেন, এমন কাজ নাই, তদ্ভিন্ন মন দেন, এমন বিষয় নাই । যাহারা ইন্দ্ৰিয়াসক্ত, তাহদের অপেক্ষাও ইহার নিকৃষ্ট । ইহাদের নিকট ধৰ্ম্ম কিছুই নহে, কৰ্ম্ম কিছুই নহে, জ্ঞান কিছুই নহে, ভক্তি কিছুই নহে। তঁাহারা ঈশ্বর মানিলেও কাৰ্য্যতঃ ভঁাহাদের কাছে ঈশ্বর নাই, জগৎ থাকিলেও তঁহাদের কাছে জগৎ নাই, কেবল আপনিই আছেন, আপনি ভিন্ন আর কিছুই নাই। ইন্দ্ৰিয়াসক্তির অপেক্ষাও এই আত্মাদর, এই স্বার্থপরতা, চিত্তশুদ্ধির গুরুতর বিস্ত্র । পরার্থপরতা ভিন্ন চিত্তশুদ্ধি নাই । যখন আপনি যেমন, পর তেমন, এই কথা বুঝিব, যখন আপনার সুখ, যেমন খুঁজিব, পরের সুখ তেমনি খুঁজিব, যখন আপনা। হইতে পারকে ভিন্ন ভাবিব না, যখন আপনার অপেক্ষাও পারকে আপনার ভাবিব, যখন ক্ৰমশঃ আপনাকে ভুলিয়া গিয়া, পরকে সৰ্ব্বস্ব জ্ঞান করিতে পারিব, যখন পরেতে আপনাকে নিমজিত রাখিতে পারিব, যখন আমার আত্মা এই বিশ্বব্যাপী বিশ্বময় হইবে, তখনই চিত্তশুদ্ধি হইবে । তাহা না হইলে ডোরকোপীন ধারণ করিয়া, সমস্ত সংসার পরিত্যাগ করিয়া, ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনপূর্বক দ্বারে দ্বারে হরিনাম করিয়া ফিরিলে চিত্তশুদ্ধি হহবে না। পক্ষান্তরে, রাজসিংহাসনে হীরকমণ্ডিত হইয়া বসিয়াও যে রাজা জনৈক ভিক্ষুক প্রজার দুঃখ আপনার দুঃখের মত ভাবে, তাহার চিত্তশুদ্ধি হইয়াছে। যে ঋষি, বিশ্বামিত্ৰকে একটি গাভীদান করিতে পারিলেন না, তঁাহার চিত্তশুদ্ধি হয় নাই । যে রাজা, অঙ্কগত কপোতের বিনিময়ে আপনার মাংস কাটিয়া দিয়াছিলেন, তঁহারই চিত্তশুদ্ধি হইয়াছিল। ইহা অপেক্ষাও চিত্তশুদ্ধির গুরুতর লক্ষণ আছে। যিনি সকল শুদ্ধির স্রষ্টা, যিনি শুদ্ধিময়, যাহার কৃপায় শুদ্ধি, যাহার চিন্তায় শুদ্ধি, র্যাহার অনুকম্প ব্যতীত শুদ্ধি নাই, র্তাহাতে গাঢ় ভক্তি চিত্তশুদ্ধির প্রধান লক্ষণ। ইন্দ্ৰিয়সংযমই বল, আর পরার্থপরতাই বল, র্তাহার সম্পূর্ণ স্বভাবের চিন্তা এবং তৎপ্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ব্যতীত কখনই লব্ধ হইতে পারে না। এই ভক্তি চিত্তশুদ্ধির মূল এবং ধৰ্ম্মের মূল।