পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰবন্ধ-দ্বিতীয় ভাগ والا في রহিল। সেই অবধি, যখন আবার সেইরূপ ক্লিষ্ট মুখমণ্ডল দেখিব, তখন আমাদের সেই শোক মনে পড়িবে—হৃদয়ে সেই শোকের আবির্ভাব হইবে । অতএব সেই ধ্বনি, এবং সেই মুখের ভাব, উভয়ই আমাদের মনে শোকের চিহ্নস্বরূপ । সেই ধ্বনিতে সেই শোক মনে পড়ে। মানস প্রকৃতির নিয়মানুসারে ইহার আর একটি চমৎকার ফল জন্মে। শব্দ, এবং মুখকান্তি, উভয়ই শোকের চিহ্ন বলিয়া পরস্পরকে স্মৃতিপথে উদ্দীপ্ত করে। সেইরূপ শব্দ শুনিলেই, সেইরূপ মুখকান্তি মনে পড়ে ; সেই-- রূপ মুখ দেখিলেই, সেইরূপ শব্দ মনে পড়ে। এইরূপ ভুয়োভূয়ঃ উভয়ে একত্র স্মৃতিগত হওয়াতে, উভয়ে উভয়ের প্রতিমা স্বরূপে পরিণত হয়। সেই শোকব্যঞ্জক মুখাবয়বকে সেই শোকসূচক ধ্বনির সাকার প্রতিমা বলিয়া বোধ হয়। ধ্বনি এবং মূৰ্ত্তির এইরূপ পরস্পর সম্বন্ধাবলম্বন করিয়াই প্রাচীনের রাগ রাগিণীকে সাকার কল্পনা করিয়া, তাহাদিগের ধ্যান রচনা করিয়াছেন। সেই সকল ধ্যান, প্রাচীন আৰ্য্যদিগের আশ্চৰ্য্য কবিত্বশক্তি ও কল্পনাশক্তির পরিচয়স্থল। আমরা পূৰ্বপুরুষদিগের কীৰ্ত্তি যতই আলোচনা করি, ততই তঁহাদিগের মহানুভাব দেখিয়াই চমৎকৃত হই। দুই একটি উদাহরণ দিই। অনেকেই টোড়ি রাগিণী শুনিয়াছেন। সহৃদয় ব্যক্তিরা তচ্ছ বণে যে একটি অনিৰ্ব্বচনীয় ভাবে অভিভূত হয়েন, তাহ সহজে বক্তব্য নহে। সচরাচর যাহাকে কবিরা “আবেশ” বলিয়া থাকেন, তাহা ঐ ভাবের একাংশ-কিন্তু একাংশমাত্র। তাহার সঙ্গে ভোগাভিলাষ মিলিত কর । সে ভোগাভিলাষ নীচপ্ৰবৃত্ত মহে। যাহা কিছু নিৰ্ম্মল সুখকর, অন্য জনের অসাপেক্ষ, কেবল আধ্যাত্মিক, সেই ভোগেরই অভিলাষ । কিন্তু সে ভোগাভিলাষের সীমা নাই, তৃপ্তি নাই, রোধ নাই, শাসন নাই । ভোগে এবং ভোগসুখে অভিলাষ আপনি উছলিয়া উঠিতেছে । আকাজক্ষা বাড়িতেছে। প্রাচীনেরা এই টোরি রাগিণীর মূৰ্ত্তি কল্পনা করিয়াছেন, সে পরমসুন্দরী যুবতী, বস্ত্ৰালঙ্কারে ভূষিতা, কিন্তু বিরাহিণী। আকাঙ্ক্ষার অনিবৃত্তিহেতুই তাহাকে বিরাহিণী কল্পনা করিতে হইয়াছে। এই বিবাহিণী সুন্দরী বনবিহারিণী, বনমধ্যে নির্জনে একাকিনী বসিয়া মধুপানে উন্মাদিনী হইয়াছে, বীণা বাজাইয়া গান করিতেছে, তাহার বসন ভূষণ সকল-স্থলিত হইয়া পড়িতেছে, বনহরিণীসকল আসিয়া, তাহার সম্মুখে তটস্থভাবে দাড়াইয়া রহিয়াছে । এই চিত্র অনির্বচনীয় সুন্দর-কিন্তু সৌন্দৰ্য্য ভিন্ন ইহার আর এক চমৎকার গুণ আছে । ইহা টোড়ি রাগিণীর যথার্থ প্ৰতিমা । টোড়ি রাগিণী শ্রবণে মনে যে ভাবের উদয় হয়, এই প্ৰতিমা দর্শনে ঠিক সেই ভাব জন্মিবে।