পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৩১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশ* কামরূপ-রঙ্গপুর কোন দেশের ইতিহাস লিখিতে গেলে সেই দেশের ইতিহাসের প্রকৃত যে ধ্যান, তাহা হৃদয়ঙ্গম করা চাই। এই দেশ কি ছিল ? আর এখন এ দেশ যে অবস্থায় দাড়াইয়াছে, কি প্রকারে—কিসের বলে এ অবস্থান্তরপ্রাপ্তি, ইহা আগে না বুঝিয়া ইতিহাস লিখিতে বসা অনর্থক কালাহরণ মাত্র। আমাদের কথা দূরে থাক, ইংরেজ ইতিহাসবেত্তাদিগের মধ্যে এই ভ্ৰান্তির বাড়াবাড়ি হইয়াছে। “বাঙ্গালার ইতিহাস” ইহার এক প্ৰমাণ । বাঙ্গালার ইতিহাস পড়িতে বসিয়া আমরা পড়িয়া থাকি, পালবংশ সেনবিংশ বাঙ্গালার রাজা ছিলেন, বখতিয়ার খিলিজি বাঙ্গালা জয় করিলেন, পাঠানেরা বাঙ্গালায় রাজা হইলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সকলই ভ্ৰান্তি ; কেন না, সেন, পাল ও বখতিয়ারের সময় বাঙ্গালা বলিয়া কোন রাজ্য ছিল না । এখনকার এই বাঙ্গালা দেশের কোন নামান্তরও ছিল না । সেন ও পাল গৌড়ের রাজা ছিলেন, বখতিয়ার খিলিজি লক্ষ্মণাবতী জয় করিয়াছিলেন । গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী বাঙ্গলার প্রাচীন নাম নহে। বাঙ্গালী বলিয়া কোন জাতি তথাকার অধিবাসী ছিল না। যাহাকে এখন বাঙ্গালা বলি, গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী তাহার এক অংশ মাত্র। সে দেশে যাহারা বাস করিত, তাহারা অন্য জাতির সঙ্গে মিশ্রিত হইয়া আধুনিক বাঙ্গালী হইয়াছে। যেমন গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী একটি রাজ্য ছিল, তেমনি আরও অনেকগুলি পৃথক রাজ্য ছিল। সেগুলি বাঙ্গালার অংশ ছিল না ; কেন না, বাঙ্গালাই তখন ছিল না। সেগুলি কোন একটি রাজ্যের অংশ ছিল না—সকলই পৃথক পৃথক, স্বস্বপ্রধান। সকলেই ভিন্ন ভিন্ন অনাৰ্য্যজাতির বাসভূমি। ভিন্ন দেশে ভিন্ন জাতি। কিন্তু সর্বত্র প্রায় আৰ্য্য প্রধান ; এই আৰ্য্যেরাই এই ভিন্ন দেশগুলি একীভূত করিবার মূল কারণ। যে দেশে যে জাতি থাকুক না কেন, তাহারা আৰ্য্যদিগের ভাষা গ্ৰহণ করিল, আৰ্য্যদিগের ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিল। আগে একধৰ্ম্ম, একভাষা, তার পর শেষে একচ্ছত্রাধীন হইয়া আধুনিক বাঙ্গালায় পরিণত হইল । কিন্তু সেই একচ্ছত্ৰাধীনত্ব সম্প্রতি হইয়াছে মাত্র, ইংরেজের সময়ে । বাঙ্গালীর দেশ, মুসলমানেরা কখনই একচ্ছত্রাধীন করিতে পারেন নাই। মোগলেরা অনেক দূর করিয়া ছিলেন, কিন্তু তঁাহারাও আধুনিক বাঙ্গালার অধীশ্বর হইতে পারেন নাই।

  • বঙ্গদর্শন, ১২৮৯, জ্যৈষ্ঠ