পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8V বিবিধ প্ৰবন্ধ গীতের পারিপাট্যজন্য আবশ্যক দুইটি-স্বরচাতুৰ্য্য এবং শব্দচাতুৰ্য্য। এই দুইটি পৃথক পৃথক দুইটি ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। দুইটি ক্ষমতাই একজনের সচরাচর ঘটে না । যিনি সুকবি, তিনিই সুগায়ক, ইহা অতি বিরল। কাজে কাজেই, একজন গীত রচনা করেন, আর একজন গান করেন । এইরূপে গীত হইতে গীতিকাব্যের পার্থক্য জন্মে। গীত হওয়াই গীতিকাব্যের আদিম উদ্দেশ্য ; কিন্তু যখন দেখা গেল যে, গীত না হইলেও কেবল ছন্দোবিশিষ্ট রচনাই আনন্দদায়ক, এবং সম্পূর্ণ চিত্তভাবব্যঞ্জক, তখন গীতোদ্দেশ্য দূরে রহিল ; আগেয় গীতিকাব্য রচিত হইতে লাগিল । অতএব গীতের যে উদ্দেশ্য, যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য, তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবোচ্ছাসের পরিস্ফুটিতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য। বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিদিগের রচনা, ভারতচন্দ্রের রাসমঞ্জরী, মাইকেল মধুসুদন দত্তের ব্ৰজাঙ্গনা কাব্য, হেমবাবুর কবিতাবলী, ইহাই বাঙ্গালা ভাষায় উৎকৃষ্ট গীতিকাব্যঙ্ক । অবকাশরঞ্জিনী আর একখানি উৎকৃষ্ট গীতিকাব্য। যখন হৃদয়, কোন বিশেষ ভাবে আচ্ছন্ন হয়,-স্নেহ, কি শোক, কি ভয়, কি যাহাই হউক, তাহার সমুদায়াংশ। কখন ব্যক্ত হয় না। কতকটা ব্যক্ত হয়, কতকটা ব্যক্ত হয় না। যাহা ব্যক্ত হয়, তাহা ক্রিয়ার দ্বারা বা কথা দ্বারা । সেই ক্রিয়া এবং কথা নাটককারের সামগ্ৰী। যেটুকু অব্যক্ত থাকে, সেইটুকু গীতিকাব্যপ্রণেতার সামগ্ৰী । যেটুকু সচরাচর অদৃষ্ট, আদর্শনীয়, এবং অন্যের অননুমেয় অথচ ভাবাপন্ন ব্যক্তির রুদ্ধ হৃদয়মধ্যে উচ্ছসিত, তাহা তাহাকে ব্যক্ত করিতে হইবে । মহাকাব্যের বিশেষ গুণ এই যে, কবির উভয়বিধ অধিকার থাকে ; ব্যক্তিব্য এবং অব্যক্তব্য, উভয়ই র্তাহার আয়ত্ত । মহাকাব্য, নাটক এবং গীতিকাব্যে এই একটি প্রধান প্ৰভেদ বলিয়া বোধ হয়। অনেক নাটককৰ্ত্তা তাহা বুঝেন না, সুতরাং তঁহাদিগের নায়ক নায়িকার চরিত্র অপ্ৰাকৃত এবং বাগাড়ম্বরবিশিষ্ট হইয়া উঠে। সত্য বটে যে, গীতিকাব্যলেখককেও বাক্যের দ্বারাই রসোস্তাবনা করিতে হইবে ; নাটককারেরও সেই বাক্য সহায় । কিন্তু যে বাক্য ব্যক্তিব্য, নাটককার কেবল তাহাই বলাইতে পারেন । যাহা অব্যক্তব্য, তাহাতে গীতিকাব্যাকারের অধিকার । উদাহরণ ভিন্ন ইহা অনেকে বুঝিতে পারিবেন না। কিন্তু এ বিষয়ের একটি উত্তম উদাহরণ উত্তবচরিত সমালোচনায় উদ্ধৃত হইয়াছে। সীতা বিসর্জনকালে ও তৎপরে রামের ব্যবহারে যে তারতম্য ভবভূতির নাটকে এবং বাল্মীকির রামায়ণে দেখা যায়, তাহার আলোচনা করিলে এই কথা হৃদয়ঙ্গম হইবে। রামের চিত্তে যখন যে ভাব উদয় হইতেছে, যখন এই প্ৰবন্ধ লিখিত হয়, তখন রবীন্দ্রবাবুর কাব্য সকল প্ৰকাশিত হয় নাই