পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ অনুকরণ ዓS শৈশবে পরের হাতে ধরিয়া যে জলে নামিতে না শিখিয়াছে, সে কখনই সাতার দিতে শিখে নাই ; কেন না, ইহজন্মে তাহার জলে নামাই হইল না । শিক্ষকের লিখিত আদর্শ দেখিয়া যে প্ৰথমে লিখিতে না শিখিয়াছে, সে কখনই লিখিতে শিখে নাই। বাঙ্গালি যে ইংরেজের অনুকরণ করিতেছে, ইহাই বাঙ্গালির ভরসা। তবে লোকের বিশ্বাস এই যে, অনুকরণের ফলে কখন প্রথম শ্রেণীর উৎকর্ষ প্ৰাপ্তি হয় না । কিসে জানিলে ? প্ৰথম, সাহিত্য সম্বন্ধে দেখ। পৃথিবীর কতকগুলি প্রথম শ্রেণীর কাব্য, কেবল অনুকরণ মাত্র। ড্রাইডেন এবং বোয়ালোর অনুকারী পোপ, পোপের অনুকারী জনসন। এইরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লেখকদিগের দৃষ্টান্ত দেখাইয়া আমরা এ কথা সপ্রমাণ করিতে চাহি না । বজিলের মহাকাব্য, হোমরের প্রসিদ্ধ মহাকাদ্যের অনুকরণ। সমুদয় রোমকসাহিত্য, যুনানীয় সাহিত্যের অনুকরণ। যে রোমকসাহিত্য বৰ্ত্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার ভিত্তি, তাহা অনুকরণ মাত্র। কিন্তু বিদেশীয় উদাহরণ দূরে থাকুক। আমাদিগের স্বদেশে দুইখানি মহাকাব্য আছে—তাহাকে মহাকাব্য বলে না, গৌরবার্থ ইতিহাস বলে—তাহা পৃথিবীর সকল কাব্যের শ্রেষ্ঠ । গুণে উভয়ে প্রায় তুল্য ; অল্প তারতম্য। একখানি আর একখানির অনুকরণ । মহাভারত যে রামায়ণের পরকালে প্রণীত, তাহা হুইলর সাহেব ভিন্ন বোধ হয়। আর কেহই সহজ অবস্থায় অস্বীকার করিবেন না। অন্যান্য অনুকৃত এবং অনুকরণের নায়কসকলে যতটা প্ৰভেদ দেখা যায়, রামে ও যুধিষ্ঠিরে তাহার অপেক্ষা অধিক প্ৰভেদ নহে। রামায়ণের অমিতবলধারী বীর, জিতেন্দ্ৰিয়, ভ্ৰাতৃবৎসল লক্ষ্মণ মহাভারতে অৰ্জ্জুনে পরিণত হইয়াছেন, এবং ভরত শত্রুঘ্ন নকুল সহদেব হইয়াছেন। ভীম, নূতন সৃষ্টি, তবে কুম্ভকর্ণের একটু ছায়ায় দাড়াইয়াছেন । রামায়ণে রাবণ, মহাভারতে দুৰ্য্যোধন ; রামায়ণে বিভীষণ, মহাভারতে বিদুর ; অভিমনু্য, ইন্দ্ৰজিতের অস্থিমজা লইয়া গঠিত হইয়াছে। এ দিকে রাম ভ্ৰাতা ও পত্নী সহিত বনবাসী ; যুধিষ্ঠিরও ভ্ৰাতা ও পত্নী সহিত বনবাসী। উভয়েই রাজ্যচু্যত । একজনের পত্নী অপহৃত, আর একজনের পত্নী সভামধ্যে অপমানিতা ; উভয় মহাকাব্যের সারভূত সমরানলে সেই অগ্নি জ্বলন্ত ; একে স্পষ্টতঃ, আপরে অস্পষ্টতঃ। উভয় কাব্যের উপন্যাসভাগ এই যে, যুবরাজ রাজ্যচু্যত হইয়া, ভ্ৰাতা ও পত্নী সহ বনবাসী, পরে সমরে প্রবৃত্ত, পরে সমরবিজয়ী হইয়া পুনর্বার স্বরাজ্যে স্থাপিত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাতেই সেই সাদৃশ্য আছে ; কুশীলবের পালা মণিপুরে বভ্ৰবাহন কর্তৃক অভিনী হইয়াছে ; মিথিলায় ধনুৰ্ভঙ্গ, পাঞ্চালে মৎস্যবিন্ধনে পরিণত হইয়াছে; দশরথকৃত পাপে এবং পাণ্ডুকৃত পাপে বিলক্ষণ ঐক্য আছে। মহাভারতকে রামায়ণের অনুকরণ বলিতে