পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২ বিভূতি-রচনাবলী দোষের মধ্যে পুষ্প ছিল অত্যন্ত গর্বিত মেয়ে । তার বিশ্বাস ছিল তার মত স্বন্দরী মেয়ে এবং তার বাবার মত সন্ত্রান্ত লোক গঙ্গার ওপারে কোথাও নেই । ধীরে ধীরে পুষ্পের সঙ্গে ওর আলাপ হয়, ধীরে ধীরে সে আলাপ জমে। ও তখন তেরো বছরের ছেলে, পুষ্প তেরো বছরের মেয়ে । সমান বয়স হোলে কি হবে, বাচাল ও বুদ্ধিমতী পুষ্পের কাছে যতীন ভেসে যেত। পুষ্প চোখে-মুখে কথা কইতো, যতীন সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার গর্বিত স্বন্দর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইত। মস্ত অশ্বখগাছ যে পুরোনো ঘাটটার ওপরে, যেটার নাম সেকালে ছিল বুডোশিবতলার ঘাট, ওই ঘাটে কতদিন সে ও পুষ্প একা বসে গল্প করেচে, জগদ্ধাত্রী পূজোর ভাসানের দিন পাপরভাজা কিনে ঘাটের রানার ওপর বসে দুজনে ভাগ ধরে খেয়েচে । কেমন করে যে সেই রূপ-গবিতা বালিকা তার মত সাদাসিধে ধরনের বালককে অত পছন্দ করেছিল, অত দিনরাত মিশতো, নিত্য তাদের বাড়ী না গেলে অমুযোগ করতো— এ সব কথা যতীন জানে না, সে সব বোঝৰার বয়েস তখন ওর হয়নি । দু-দশ দিন নয়, দেড় বছর দুবছর ধরে দুজনে কত খেলা করেচে, কত গল্প করেচে, কত ঝগড়া করেচে, পরস্পরের নামে পরস্পরের গুরুজনের কাছে কত লাগিয়েচে, আবার দুজনে পরম্পরে যেচে সেধে ভাব করেচে—সে কথা লিখতে গেলে একখানা ইতিহাসের বই হয়ে পড়ে । মাস্টীমার মৃত্যুর পরে কেওটার পথ বন্ধ হোল। বছরখানেকের মধ্যে পুষ্পও বসন্ত হয়ে মারা গেল। দেশে থাকতে পুষ্পর মৃত্যুসংবাদ মেসোমশায়ের চিঠিতে সে জেনেছিল। তারপর তেরো বছর কেটে যাওয়ার পরে ছাব্বিশ বছর বয়সে যতীন বিবাহ করে । বাল্যের তেরো বছর –বহুদিন । পুপ তখন ক্ষীণ স্মৃতিতে পর্যবসিত হয়েচে । তারপর আশালতার সঙ্গে নবীন অকুরাগের রঙীন দিনগুলিতে পুষ্প একেবারে চাপা পড়ে গেল। কিন্তু চাপা পড়ে যাওয়া আর ভুলে যাওয়া এক জিনিস নয়। মানুষের মনের মন্দিরে অনেক কক্ষ, এক এক কক্ষে এক এক প্রিয় অতিথির বাস। সে কক্ষ সেই অতিথির হাসিকান্নার সৌরভে ভরা, আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না। প্রেমের এ অতিথিশালা বড় অদ্ভুত, অতিথি যখন দূরে থাকে তখনও যে কক্ষ সে একবার অধিকার করেছে সে তারই এবং তারই চিরকাল । আর কেউ সে কক্ষে কোনো দিন কোনো কালে ঢুকতে পারে না। সে যদি আর ফিরেও না আসে কখনো, চিরদিনের জন্তই চলে যায়—এবং জানিয়ে দিয়েও যায় যে সে ইহজীবনের মতই চলে যাচ্ছে—তখন তার সকল স্মৃতির সৌরভ স্বদ্ধ সে ঘরের কবাট বন্ধ করে দেওয়া হয় —তারই নাম লেখা থাকে সে দোরের বাইরে । তার নামেই উৎসুগীকৃত সে ঘর আর-কারো অধিকার থাকে না দখল করবার। * পুষ্পের ঘরের কবাট বন্ধ ছিল --চাবি দেওয়া, বাইরে ছিল পৃষ্পের নাম লেখা। হয়তো চাবিতে মরচে পড়েছিল, হয়তো কৰাটের গায়ে ধুলো মাকড়সার জাল জমেছিল, হয়তো এ ঘরের সামনে অনেক দিন কেট আসে নি, কিন্তু সে ঘর দখল করে কার সাধ্য ? অাশালত সে ঘরে ঢোকেমি—-আশালতার ঘর আলাদা । সেই পুষ্প ।