পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

38 বিভূতি-রচনাবলী লজ্জিতও হোল । এতখানি প্রশংসার উপযুক্ত সে নয় তা সে জানে। তবে হবার চেষ্ট আজ থেকে তাকে করতেই হবে । কিছু পরে পুষ্প ও যতীনের পায়ের তলায় বিশাল ভলগা একটা সরু রৌপ্যস্থত্রের মত হয়ে ক্রমশঃ অদৃত হয়ে গেল। সেদিনের মত ওরা বিদায় নিলে । পুপদের বুড়োশিবতলার বাড়ীতে আজকাল দেবী প্রায়ই আসেন । একে আমরা করুণাদেবী বলে পরিচয় দেবো। করুণাদেবী অতি উচ্চস্তরের নীলজ্যোতিবিশিষ্ট আত্মা— কিন্তু পৃথিবীর কাছাকাছি তিনি থাকতে ভালবাসেন, কারণ পৃথিবীর আর্য জীবকুল ছেড়ে উধের স্বর্গে গিয়ে তিনি শান্তি পান না। এর চরিত্রের মাধুর্যে ও স্বন্দর ব্যবহারের কথা শুনে পুপ ও যতীন এর প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল ! যখনই তিনি আসতেন, একরাশ ফুল ও ফল নিয়ে আসতেন ওপরের স্বর্গ থেকে । সে ফুল যেন স্পন্দনশীল আলোর তৈরী-খাওয়া যায়, খুব স্বস্বাদু এবং ভারি চমৎকার ভুরভূরে স্বগন্ধ তার । সে ফল খেলে মনে শক্তি ও পবিত্রত আসে, এই তার গুণ । কিন্তু এই নিম্নতর তৃতীয় স্বর্গে সে ফল বেশী সময় থাকতো না--কিছুক্ষণ পরেই ঠিক কপুরের দলার মত উবে যেত । দেবী বলতেন, ওপরকার জগতের এই সব ফল পৃথিবীর ন্যায় স্থল দেহের স্বষ্টির জন্যে জন্মায় না, মনের আধ্যাত্মিক পুষ্টির খোরাক যোগানোই এদের কাজ । সেদিন তখন ওদের বাড়ীতে সকালবেলা করে রেখেছে পুপ । ঠিক যেন পৃথিবীর সকাল, লতাপাতায় শিশির, পাখী ডাকচে ও গঙ্গার ওপারে সূর্য উদয় হচ্চে, পুষ্প সবে গঙ্গাস্নান করে শিবমন্দিরে পূজো করতে যাচ্চে, এমন সময় করুণাদেবী এলেন । পুপকে বল্পেন—বেশ সকালটি করে রেখেচ তো ! পূজে সেপ্লে নাও, চল তুমি আর যতীন আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে ! যতীন ঘরের মধ্যে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল । দেবীকে বসবার আসন দিয়ে সে দাড়িয়ে রইল। করুণাদেবী বল্লেন –তুমি পুজো কর না ? —ওতে আমার বিশ্বাস নেই । আমার মনে হয় পৃথিবীতে দেবতা ও ভগবান সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা গড়ে ওঠে, এখানে এসে তার আমূল সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সে ভাবের দেবতা কই এখানে ? সে ভাবের ভগবানই বা কোথায় ? পুষ্প মেয়েমানুষ, ওর মনে ভক্তি ও পুজাৰ্চনার প্রবৃত্তি কোনো প্রশ্ন ওঠায় না। বিনা দ্বিধায় বিনা প্রশ্নে সে পূজার ফুল তার মন-গড়া ইষ্টদেবের পায়ে দেয়। আমি তা শারি না। আমার মনে হয় করুণাদেবী বল্পেন—তোমার এ কথার মধ্যে ভুল রয়েচে, যতীন । তুমি ভেবে না ভগবান সম্বন্ধে তুমি কোনো ধারণা কখনো করে উঠতে পারবে। তুমি কোথায়, আর সেই বিরাট বস্তু, র্যাকে পৃথিবীতে বলে ভগবান, তিনিই বা কোথায় ? অতএব ভক্তি ও অর্চনা-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে হোলে তোমায় মনের মত ভগবান তোমাকে গড়ে নিতে হবে । তোমার সেই মন-গড়া দেবতার মধ্যে দিয়েই অর্ঘ্য পৌছোবে সেই বিশ্বদেবের পায়ে । তুমি তৃতীয়-স্বৰ্গবাসী জীব, এর বেশী কি করতে পারো ?