পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

| > o || মাস পাচ-ছয় পরে ঘুরতে ঘুরতে একবার গেলাম দাদার বাড়িতে । দাদা ছিল না বাড়ি, বৌদিদি বাটন-মাখা হাতে ছুটে বার হয়ে এল—আমার হাত থেকে পুঁটুলিটা নিয়ে বললে—এস এস ঠাকুরপো, রন্ধ রে মুখ রাঙা হয়ে গিয়েচে একেবারে। কই, আসবে বলে চিঠি দেও নি তো! তা হলে একখানা গরুর গাড়ি স্টেশনে যেত । তখনই বৌদিদি চিনি ভিজিয়ে শরবৎ ক’রে নিয়ে এল। বললে—ঠাকুরপো, তোমার মায়া নেই শরীরে। এত দেরি করে আসতে হয় ? উনি কেবল বলেন তোমার কথা। বিকেলে দাদা এল। আমার পেয়ে যেন হাতে স্বৰ্গ পেলে। কিসে আমার মুখস্থবিধে হবে, কিসে আমায় বড় মাছ, ভালটা-মন্দটা খাওয়ানো যাবে, এই যোগাড়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল । এরা বেশ মুখে আছে। দাদা যা চাইত, তা সে পেরেচে। সে চিরকালই সংসারী মাহুষ, ছেলেপুলে গৃহস্থালী নিয়েই ও সুখী, তাই নিয়েই ও থাকতে ভালবাসে। ছেলেবেলা থেকে দাদাকে দেখে এসেচি, সংসার কিসে গোছালো হবে, কিসে সংসারের দুঃখ ঘুচবে, এই নিয়েই সে ব্যস্ত থাকত। লেখাপড়াই ছেড়ে দিলে আমাদের দু-পয়সা এনে থাওয়াবার জন্তে। কিন্তু পরের বাড়িতে পরের তৈরী ব্যবস্থার গওঁীর মধ্যে সেখানে তো কোন স্বাধীনতা ছিল না, কাজেই দাদার সে সাধ তখন আর মেটে নি। যার জন্তে ওর মন চিরকাল পিপাসিত ছিল, এত দিনে তার সন্ধান মিলেচে, তাই দাদা সুখী । দাদা ও বৌদিদি একই ধরনের মানুষ । নীড় বাধবার আগ্রহ ওদের রক্তে মেশানো রয়েছে। বৌদিদির বাপের বাড়ির অবস্থা খারাপই। একান্নবর্তী প্রকাও পরিবারের মেয়ে সে। তার বাপের বাড়িতে সবাই একসঙ্গে কষ্ট পায়, সবাই ছেড়া কাপড় পরে, এক ঘরে পুরানো লেপকাথা পেতে শীতের রাতে তুলে বেরুনো, ওয়াড়-হীন ময়লা লেপ টানাটানি ক’রে ছেলেপুলের রাত কাটায়—সব জিনিসই সকলের, নিজের বলে বিশেষ কোন ঘরদেরও নেই, তৈজসপত্রও নেই—সেই রকম ঘরে বৌদিদি মানুষ হয়েচে । এতকাল পরে সে এমন কিছু পেয়েছে যাকে সে বলতে পারে এ আমার । এ আমার স্বামী, আমার ছেলে, আমার ঘরদ্রোর—আর কারও ভাগ নেই এতে। এ অনুভূতি বৌদিদির জীবনে একেবারে নতুন । দাদা আমায় তার পরদিন সকালে ওর কপির ক্ষেত, শাকের ক্ষেত দেখিয়ে বেড়ালে । বৌদিদি বললে—শুধু ওদিক দেখলে হবে না ঠাকুরপো, তুমি আমার গোয়াল দেখে যাও ভাই এদিকে। এই স্থাখে৷ এই হচ্চে মুংলী। মঙ্গলবারে সনোবেল ও হয়, ওই সজনেগাছতলায় তখন গোয়াল ছিল । ও হ'ল, সেই রাতেই বিষম ঝড় ভাই । গোয়ালের চালা তো গেল উড়ে। তারপর এই নতুন গোরাল হয়েচে এই বোশেখ মাসে–বৌদিদি বাছুরের গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললে—বডড পরমস্ত বাছুর, যে-মাসে হ’ল সেই মাসেই ওঁর সেই মনিব আমায় শাখা-শাড়ি পাঠিয়ে দিলে, ওর দু-টাক মাইনে বাড়ালে । দিনকতক যাবার পরে বৌদিদির একটা গুণ দেখলাম, লোককে খাওয়াতে বড় ভালবাসে। অসময়ে কোন ফকির বৈষ্ণব, কি চুড়িওয়ালী বাড়িতে এসে খেতে চাইলে নিজের মুখের ভাত তাদের খাওয়াবে। নিজে সে-বেলাটা হয়ত মুড়ি থেয়ে কাটিয়ে দিলে। এক দিন একটা ছোকরা কোথা থেকে একথানা ভাঙা খোল ঘাড়ে ক’রে এসে জুটলো । তার মুখে ও গালে কিসের ঘ, কাপড়-চোপড় অতি নোংরা, মাথার লম্বা লম্ব চুল। ছ-সাত দিন রইল, দাদাও কিছু বলে না, বৌদিদিও না। আমি একদিন বৌদিদিকে বললাম—বৌদি,