পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૨ বিভূতি-রচনাবলী দেখচো না ওর মুখে কিসের ঘা। বাড়ির থালা গেলাসে ওকে খেতে দিও না। ও ভাল ঘা নয়, ছেলেপুলের বাড়ি, ওকে পাতা কেটে আনতে বললেই তো হয়, তাতেই খাবে। আট দিন পর ছোকরা চলে গেল। বোধ হয় আরো আট দিন থাকলে দাদা বৌদিদি আপত্তি করত না । বৌদিদি খাটতে পারে ভূতের মত । ঝি নেই, চাকর নেই, এক হাতে কচি ছেলে মানুষ করা থেকে শুরু করে ধানসেদ্ধ, কাপড়-কাচ, বাসন-মাজা, জল-তোলা—সমস্ত কাজই করতে হয়। কোনদিন ব্যাজার হতে দেখলাম না সেজন্তে বৌদিদিকে । এদের মায়ায় আমিও যেন দিনকতক জড়িয়ে গেলাম। এরকম শাস্তির সংসার কতকাল ভোগ করি নি—বোধ হয় চা-বাগানেও না, কারণ সেখানে বাবা মাতাল হয়ে রাত্রে ফিরবেন, সে ভয় ছিল । ভেবে দেখলাম সত্যিকার শাস্তি ও আনন্দভরা জীবন আমরা কাকে বলে কোনদিন জানি নি—স্রোতের শেওলার মত বাবা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এ চা-বাগানে ও চা-বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, শেষকালে না-হয় কিছুদিন উমপ্লাং বাগানে ছিলেন—এতে মন আমাদের এক জায়গায় বসতে ন বসতেই আবার অন্ত জায়গায় উঠে যেতে হ’ত—এই সব নানা কারণে নিজের ঘর, নিজের দেশ, এমন কি নিজের জাতি ব’লে কোন জিনিস আমাদের ছিল না। তার অভাব যদিও আমরা কোনদিন অনুভব করি নি—অত অল্পবয়সে করবার কথাও নয়—বিশেষ ক’রে যখন হিমালয় আমাদের সকল অভাবই পূর্ণ করেছিল আমাদের ছেলেবেলাতে। এখানে সকলের চেয়ে আমার ভাল লেগেচে বৌদিকে। আমি বৌদিদির ধরনের মেয়ে কখনও দেখি নি। যা তা জিনিস দিয়ে বোঁদিকে খুশী করা যায়, যে-কোন ব্যাপার যত অসম্ভবই হোক না কেন—বৌদিদিকে বিশ্বাস করানো যায়, খুব অল্পেই ভয় দেখানো যায়—ঠকিয়ে কোন জিনিস বৌদিদির কাছ থেকে আদায় করা মোটেই কঠিন নয়। অথচ একটি সহজাত বুদ্ধির সাহায্যে বৌদিদি ঘরকন্না ও সংসার সম্বন্ধে দাদার চেয়েও ভাল বোঝে, বড় কিছু একটা আশা কখনও করে না, ভারি গোছালো, নিজের ধরনে ঠাকুরদেবতার ওপর ভক্তিমতী । কেবল একটা দোষ আমার চোখে বড় লাগে—নিজে যে-সব কুসংস্কার মানে, অপরকে সেই সব মানতে বাধ্য করবে। অনেক ব্যাপারে দেখলাম ভাবটা এই রকম, আমার সংসারে যতক্ষণ আছ ততক্ষণ তোমায় মানতেই হবে, তার পর বাইরে গিয়ে হয় মেনে না-হয় না-মেনো—কড়া কথা ব’লে নয়, মিনতি অনুরোধ করে মানাব। কড়া কথা বলতে বৌদিদি জানে না—টকের বীজ নেই কোথাও বৌদিদির স্বভাবে, সবটাই মিষ্টি । সপ্তাহ দুই পরে ওদের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসবার সময়ে দাদা বললে —শোন জিতু, আটঘরার বাড়ি সম্বন্ধে কি করা যাবে, তুই একটা মত দিস। ছোটকাকীমা ঠিকই বলেচেন—ও বাড়ি আমরা ছাড়বে না। আর একটা কথা শোন, একটা চাকরি দেখে নে, এরকম করে বেড়াস নে। তোর বৌদিদি বলছিল এই বছরই তোর একটা বিয়ে দিয়ে দিতে। তার পর দু-ভায়ে মিলে ঘরবাড়ি করি আয়, দুজনে মিলে টাকা আনলে ভাবনা কিসের সংসার চালাবার ? সংসারটা বেশ গড়ে তুলতে পারবো এখন। আর ছাখ, পয়সা রোজগার করতে না পারলে, ঘরবাড়ি না থাকলে কি কেউ মানে ? নিজের বাড়ি কোথাও একখানা থাকা চাই, নইলে লোকে বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। দাদার শুধু সংসার আর সংসার। আর লোকে আমার সম্বন্ধে কি ভাবলে না-ভাবলে তাতেই বা আমার কি ? লেখাপড়া শিখলে না কিছু না, দাদা যেন কেমন হয়ে গিয়েচে । লোকে কি বলবে সেই ভাবনাতেই আকুল । দাদার ওই সব ছাপোষা গেরস্তালী-ধরনের কথাবাৰ্ত্তায় আমার হাসি পায়, দাদার ওপর কেমন একটা মায়াও হয় ।