পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৯৬ বিভূতি-রচনাবলী গোলমালে চুরি হয়েচে । এমন কি টাকার অভাবে বুড়োর ছেরান্ধটাও হ’ল না। পেটের ওপর বাণিজ্য করে টাকা জমিয়ে গেল, নিজের ভোগে তো লাগলোই না—একটিমাত্তর মেয়ে এই কাপাসীর মা, তার ভোগেও হ'ল না। টাকার মালা রাতারাতি কে যে কোথায় সরিয়ে ফেলল— কাপাসীর মা বীজের সঙ্গে বলে উঠল—হ্যাগে হ্যা, সরিয়ে ফেলতে এসেছিল পাড়ার লোক ! যে নেবার সে নিয়েছে। আমি কি আর কিছু জানি নে, না বুঝি নে ? ধৰ্ম্ম আছেন মাথার ওপর—তিনি দেখবেন। ছমাসের মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়ে লোকের দোর দোর ঘুরিচি দুটো ভাতের জন্তি—আমার যিনি বাপের ধনে— বাবুরাম বললে—আর শাপময়ি করে না বাপু তোমার আদেষ্টে থাকত, পেতে। বাদ দেও ওসব কথা । উকুনে আগুন আছে কিনা দেখো তো, আর একবার কলকেটা ধরাই । ওদের মধ্যে আর একজন বললে—ও জুড়নখুড়ে, স্বরূপগঞ্জের বাজারে কাল দুপুরের আগে পৌঁছানো যাবে না? —দুটোর কম হবে না। ছ'উী কোশ, তার আগে খাওয়া-দাওয়া করে নেওয়া যাবে। বাবুরাম বললে—এবার কেঁচুলির মেলায় লোক যাচ্ছে কই তেমন জুড়নখুড়ো-সে-বছর দেখেছিলে তো ? পথে সারারাতই লোক হাটতো । অদ্ভুত লাগছিল এ রাতটি আমার কাছে। এত কথাও মনে এনে দেয়! ঘুম আর আসে না। ভাবছিলাম মানুষ এত অল্পেও সুখী হয় ? আর মুখ জিনিসটা কি অনির্দেশু রহস্যময় ব্যাপার—এই নির্জন রাত্রে মুক্ত অপরিচিত প্রান্তরের মধ্যে তারাখচিত আকাশের নীচে শুয়ে সবাই মুখের স্বপ্ন দেখছে—কিন্তু একজনের মুখের ধারণার সঙ্গে অন্ত আর একজনের ধারণার কি বিষম পার্থক্য ] সকালে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পশ্চিম মুখেই হাটি। রাঢ় দেশের বড় বড় মাঠের ওপর দিয়ে পথ । রাঙা বালি, দিগন্তে তালবনের সারি। হয়ত মাঠের মাঝে প্রাচীন কালের প্রকাও দীঘি, তালবনে ঘেরা। কি ফাক জায়গা এসব ! মনে হ’ত যেন সীমাহারা দিকৃসমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে চলেছি, কোন অজ্ঞাত দিগন্তের বননীল উপকূলে গিয়ে ভিড়বে, কোনখানে তমালতরুনিকরে বনভূমি শুমায়মান, সেখানে গন্ধভরা অন্ধকার বীথিপথ বেয়ে অভিসারিকার চিরদিন পা টিপে টিপে হাটে ; বৃন্দাবনের দিন ফুরিয়ে গেল, মহাভারতের যুগ কেটে গেল, যমুনার তটে কেলিকদম্বের ছায়া কালের অন্ধকারে লুকিয়েছে, তবুও ওদের ও যাওয়ার শেষ হবে না, আমারও না । - মাঠের পথের প্রথমটায় কেঁজুলি মেলার লোকজনের সঙ্গে দেখা হত। পরে আর তেমন লোক দেখি নি, এত বড় মাঠের মধ্যে অনেক সময় আমি একাই পথিক। এই ধুধু সীমাহীন প্রাস্তরে স্বৰ্য্যান্তের কি মূৰ্ত্তি । আমাদের অঞ্চলে কোনোদিন তা দেখি নি। অন্ধকার হলে মাঠের মধ্যেই কতদিন রাত কাটিয়েছি। ছেলেবেলায় চা-বাগানে কাটিয়ে এই শিক্ষা পেয়েছিলাম, রাত্রিতে যে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে, একথা মনেই ওঠে না। শীতের দেশ নয়, ঘন হিমারণ্যের হিংস্ৰ শ্বাপদ নেই এখানে—নিতান্ত নিরীহ, নিরাপদ দেশ–এখানে নক্ষত্রভরা মুক্ত আকাশের চাদোয়ার তলায় মাটির ওপর যা-হয় একটা কিছু পেতে রাত কাটানোর মত আনন্দ খাট-পালঙ্কে শুয়ে পাই নি । একদিন এই অবস্থার একটি অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হল। একটা অপূৰ্ব্ব নাম-না-জানা অনুভূতির