পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ సినీ মেয়েটি বললে—আমাদের সুবিধে নিয়ে নয়—এখানে আপনার বা ইচ্ছে হবে খেতে তাই বলবেন । চা খান কি আপনি ? এ পর্যন্ত কোন জায়গায় এমন কথা শুনি নি, কোন মন্দিরে বা বৈষ্ণবের আখড়াতেই নয়। ডেকে কেউ জিজ্ঞেস করে নি আমি কি খেতে চাই । বললাম—চা খাওয়া অভ্যেস আছে, তবে সুবিধে না হ’লে— মেয়েটি আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই চলে গেল এবং মিনিট কুড়ি পরে এক পেয়ালা চা নিয়ে এসে নিঃসঙ্কোচে আমার হাতেই দিলে। বললে—চিনি ঠিক হয়েছে কি না দেখুন। আবার তাকে দেখলাম রাত্রে খাবার সময়ে । লম্বা দাওয়ায় সারি দিয়ে সাত-আট জন লোক খেতে বসেছে, মেয়েটি নিজের হাতে সবাইকে পরিবেশন করলে। প্রকাও বড় ভাতের ডেকচি নিজে দু-হাতে ধরে নিয়ে এসে আমাদের সামনে রাখলে—তা থেকে থালা ক'রে ভাত নিয়ে সকলকে দিতে লাগল। আমার পাশের লোকটিকে বললে—ও কি শু্যামাকাকা, নাউয়ের ঘণ্ট দিয়ে আর দুটো খান। ওবেলা তো খাওয়াই হয় নি! সে সসন্ত্রমে বললে—না দিদিঠাকৃরুন, আমাকে বলতে হবে না আপনার । পেটে জায়গা নেই। তেঁতুল মেখে বরং দুটো খাবে।— —হঁ্যা কাসছেন, তেঁতুল না খেলে চলবে কেন ? দুধ দিচ্ছি— * তারপর আমার সামনে এসে বললে—আপনার বোধ হয় ওবেলা খাওয়াই হয় নি ? আপনাকেও দুধ দিচ্ছি। এতগুলো লোক খেতে বসেছে, দুধ দেওয়া হ’ল মোটে তিনজনকে—কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রয়োজন বিশেষে এবং তার বিচারকত্রী ওই মেয়েটিই। আমার কৌতুক হ’ল ভারি। রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম চমৎকার মেয়েটি তো ! দেখতে মুত্র বটে, তবে খুব মুনারী নয় । কিন্তু আমি ওরকম মুখের গড়ন কখনও দেখি নি, প্রথমে সন্ধ্যাবেলায় ওকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল একথা। বার বার চেয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়—সে ওর মুন্দর ডাগর চোখ দুটির জন্তে, না ওর মুখের একটি বিশিষ্ট ধরনের লাবণ্যময় গড়নের জন্তে, রাত্রে তা ভাল বুঝতে পারি নি। মেয়েটি কে ? নিতান্ত ছেলেমানুষ তো নয়—সারাদেহে যৌবনী ফুটে উঠেচে পরিপূর্ণ ভাবেই —এখানে ওভাবে থাকে কেন । আখড়ার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক ? নানা প্রশ্ন মনে উঠে ঘুম আর আসে না । পরদিন সকালে মেয়েটির সঙ্গে অনেকবার দেখা হ’ল । অতিথিদের কারও অযত্ব না হয় সেদিকে দেখলাম ওর বেশ দৃষ্টি আছে। এ অঞ্চলে চালে কাকর বলে সে নিজে সকালে কুলো নিয়ে বসে প্রায় আধমণ চাল ঝাড়লে । বেলা ন’টার সময় হঠাৎ এসে আমায় বললে—আপনার ময়লা জাম-কাপড় যদি পুটলিতে থাকে তো দিন, কেচে দেবো। আপনার গায়ের জামাটাও ময়লা হয়ে গিয়েছে, খুলে দিন। খুব রোদ, দুপুরের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। আমি প্রথমটা একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলাম। তার পর দেখলাম সে সকলকেই জিজ্ঞেস করছে কারও ময়লা কাপড়-চোপড় কিছু আছে কিনা। একজন বৃদ্ধ বাউলের গেরুয়া আলখাল্লা ময়লা হয়েছিল বলে খুলিয়ে নিয়ে গেল। পরে শুনলাম মেয়েটি ওরকম প্রায়ই করে, আখড়াতে ময়লা-কাপড়ে থাকবার জো নেই। এখানে দিন দুই কাটাবার পরে আর একটা জিনিস আমার বিশেষ ক'রে চোখে পড়ল যে, মেয়েটির মধ্যে কোন মিথ্যে সঙ্কোচ নেই, সহজ সিধে ব্যবহার, কি কাজে, কি কথাবার্তায় । সজীব ও দীপ্তিমী, যেন সঞ্চারিণী দ্বীপশিখা, যদি শুামাজী মেয়েকে দ্বীপশিখার সঙ্গে তুলনা করা