পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88ર বিভূতি-রচনাবলী । খেতে খেতে ভাঙার কাছে নিয়ে এলুম। মালতী তখন অৰ্দ্ধ-অচৈতন্য, আমার ডাক শুনে আখড়া থেকে সবাই ছুটে এল—মিনিট পাচ-ছয় পরে ওর শরীর মুস্থ হ’ল। উদ্ধব বাবাজী বকলে, আমি বকলাম, সবাই বকলে। এই দিনট থেকে ওর ওপর আমার একটা কি যেন মায়া পড়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যাবেলা কেবলই মনে হতে লাগল ও এখানে নিঃসহায়, একেবারে একা । ও সবার জন্তে থেটে মরে । ওর বাপের ধানের জমির উপস্বত্ব আখড়ম্বদ্ধ বৈষ্ণব বাবাজীরা ভোগ করছে, কিন্তু ওর মুখের দিকে চাইবার কেউ নেই। ও সকলের ময়লা জামাকাপড় কেচে বেড়াবে, ভাত রোধে খাওয়াবে—সৰ্ব্বরকমে সেবা করবে, ওকে ছেলেমানুষ পেয়ে সবাই ওকে মুখের মিষ্টি তোষামোদে নাচিয়ে নিজেদের স্বাৰ্থ ষোল আনার ওপর সতের আনা বজায় রাখছে, কিন্তু ওর সুখদুঃখ কেউ দেখছে ? এই যে আজ পুকুরের ঘাটে ডুবে মরে যাচ্ছিল আর একটু হলে—আমি যদি না থাকতাম ! ভগবান আমাকে এ কিসের মধ্যে এনে ফেললেন, এ কি জালে দিন-দিন জড়িয়ে পড়ছি আমি ! এদের আখড়াতে যে বিগ্রহ আছেন, তাকে এরা মানুষের মত সেবা করে । সকালবেলা তাকে বাল্যভোগ.দেওয়া হয়, দুপুরের ভোগ তো আছেই। ভোগের পর দুপুরে বিগ্রহকে খাটে শুইয়ে মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয় । বৈকালে বৈকালিক ভোগ দেওয়া হয়— ফল, মিষ্টান্ন। রাত্রে আবার খাটে শুইয়ে মশারি টাডিয়ে দেয়—শীতের রাত্রে বিগ্রহের গায়ে লেপ, আশেপাশে বালিশ । উদ্ধবদাস বাবাজী সেদিন লাল শালু কাপড়ের ভাল লেপ করে এনেচে বিগ্রহের ব্যবহারের জন্যে—আগের লেপটা অব্যবহার্য্য হয়ে গিয়েছিল। এসব পুতুল-খেলা দেখলে আমার হাসি পায়। সেদিন সন্ধ্যার সময় এক পেয়ে মালতীকে বললাম—তোমাদের এতদিন স্থশ ছিল না মালতী ? ছেড়া লেপটা এই শীতে কি বলে দিতে ঠাকুরকে ? যদি অমুখ-বিমুখ হ’ত, এই তেপাস্তরের মাঠে না ডাক্তার, না কবিরাজ, দেখত কে তখন ? ছিঃ ছিঃ, কি কাণ্ড তোমাদের ? মালতী রাগে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। ও এসব কথা আর কাউকে বলে দেয় না ভাগ্যে, নইলে উদ্ধবদাস আখড়া থেকে আমায় বিদেয় দিতে এক বেলাও দেরি করত না। অনেক কথা আমি বলি ওদের আখড়া সম্বন্ধে, উদ্ধবদাস সম্বন্ধে—যা অপরের কানে উঠলে আমায় অপমানিত হয়ে বিদার হতে হত, কিন্তু মালতী কোন কথা প্রকাশ করে নি কোনদিন । আজকাল মালতী আমার দিকে একটু টেনে চলে বলে সেটা অনেকের চক্ষুশূলের ব্যাপার হয়ে উঠেছে—আমি তা বুঝি। | >NS)| শ্রাবণ মাসের প্রথমে আমার পাঠশালা গেল উঠে। আর আমার এখানে শুধু হাতে থাকা অসম্ভব । মালতীকে একদিন বললাম—শোন, আমি চলে যাচ্ছি মালতী— সে অবাক হয়ে বললে—কেন চলে যাবেন ? - —কতদিন এসেছি ভাবে তো এখানে ? প্রায় দশ মাস হ’ল— মালতী চুপ করে থেকে বললে—ঘুরে আবার আসবেন কবে ? —ভগবান জানেন । না-ও আসতে পারি।