পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ NS (* ঘরে কেউ নেই, নিঃসঙ্কোচে আমার কাছে বসে ও আমার খাওয়ালে—খেতে খেতে একবার ওর মুখের দিকে চাইলাম। কি অপূৰ্ব্ব স্নেহ-মমতামাখা দৃষ্টি ওর চোখে ] মালতীর কাছে এত ঘনিষ্ঠ যত্ব এই কিন্তু প্রথম । বললে—আমি কি আর দেখি নি যে আজ সারাদিন আপনি শুধু খেটেছেন আর পরিবেশন করেছেন, খাওয়া যা হয়েছিল ও-বেলায় আপনার, তার আমি সন্ধান রাখি নি ভেবেছেন ? খান,—না—ও লুচি ক-খান খেতেই হবে। খাবো কি, লুচি গলায় আটকে যেতে লাগল—সে কি অপূৰ্ব্ব উল্লাস, আমার সারাদেহে কিসের যেন শিহরণ। আজ সারাদিনের ভূতগত খাটুনির মধ্যেও মালতী দৃষ্টি রেখেছিল আমি কি খেয়েছি না-খেয়েছি তার ওপর ! ঘন বর্ষা নামল। সারা মাঠ আঁধার ক’রে মেঘ ঝুপ সি হয়ে উপুড় হয়ে আছে। এইসব দিনে মালতীকে সৰ্ব্বদা কাছে পেতে ইচ্ছে করে—ইচ্ছে করে ঘরের কোণে বসে ওর সঙ্গে সারা দিনমান বাজে বকি। কিন্তু ও আসে না, এমনই সব বর্ষার দিনে আখড়ার যত সব খুচরো কাজে ও ব্যস্ত থাকে। দু-একবার যখন দেখা হয় তখন বলি—মালতী, আস না কেন ? মালতী বলে সে আসবে। তার পর এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা কেটে যায়, ও আসে না। আমার রাগ হয়, অভিমান হয়। ও যদি আমার জন্তে একটুও ভাবত, তাহলে কি আর না এসে পারত ? ওর কাছে কাজই বড়, আমি কেউ নই। কিন্তু হয়ত অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ মালতী এসে পড়ে। প্রায়ই বিকেলের দিকে, এমন কি সন্ধ্যার সময় । চুলটি টান-টান ক’রে বেঁধে, পান খেয়ে ফুল্ল ওষ্ঠাধর রাঙা ক'রে হাসিমুখে আমার দাওয়ার সামনে এসে বলে—কি করছেন ? —এস মালতী, সারাদিন দেখি নি যে ? —আপনার কেবল—সারাদিন দেখি নি, আর, এই তখন ডাকলুম এলে না কেন, আর, কেন আস না—এই-সব বাজে কথা । আসি কখন ? দেখছেন তো । খেয়ে উঠেছি এই ভো ঘণ্টাখানেক আগে । কাজ ছিল । - —কি কাজ ছিল আমি আর জানিনে মালতী ? উদ্ধব-বাবাজীর কোণের ঘরে মেঝেতে চাটাই পেতে বসে তোমার সেই কবিতার বই লিখছিলে—আমি দেখি নি বুঝি ? —বেশ, দেখেছেন তো দেখেছেন। আসুন বিষ্ণুমন্দিরে সন্দে দেখিয়ে আসি—এক ভয় করে । বাস্তবিকই আমি ওকে একমনে বই লিখতে দেখেছিলাম। প্রায়ই দেখি। মালতী ঠিক পাগল, আচ্ছ, পাষণ্ডদলনের অনুকরণে লেখা ওর বই কে পড়বে যে রাত নেই দিন নেই বই লিখছে ! ওর মুখ দেখলে আমার কষ্ট হয়। ওই এক খেয়াল ওর। মালতীর সঙ্গে বিষ্ণুমন্দিরে গেলাম। মালতীর এই এক গুণ, ও যখন মেশে তখন মেশে নিঃসঙ্কোচে, উদার ভাবে । সে-সম্বন্ধে কোনো বাধা বা সংস্কার ও মানে না। কেন এই সন্ধ্যাতে আমার সঙ্গে একা যাবে পুকুরপাড়ের —এসব নিয়ে সঙ্কোচ নেই ওর। মন্দিরের পথে যেতে যেতে মনে হ’ল মালতীকে পেয়ে আমার এই বর্ষাসন্ধ্যাটি সার্থক হ’ল । ওকে ছেড়ে আর কিছু চাই নে । কাঞ্চনফুলতলার গিয়ে বললাম—সেই গানটা গাও না, সেদিন গাইছিলে গুনগুন করে ! মালতী ছেলেমানুষের মত ভজিতে বললে—উদ্ধব-জ্যাঠা যে শুনতে পাবেন ? —ত পাবেন, পাবেন । —তবে আমুন পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসি ।