পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ Σ Σξύ থেকে বিপথে নিয়ে গিয়ে ফেলবে—শুধু আমি এইটুকু বুঝি যে, যে কোন গতীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকলে আমার চোখের অস্বচ্ছ দৃষ্টির সামনে তার প্রবুদ্ধমান রূপ ক্ষীণ হয়ে আসবে—আমার কাছে সেই সন্ধানই সত্য—আর সব মিথ্যে, সব ছায়া । লোচনদাসের আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোন দিকে যাব তার কিছুই ঠিক নেই। বর্ষাকাল কেটে গিয়েছে, আকাশ নিৰ্ম্মল, শরতের সাদা লঘু মেঘখণ্ড নীল আকাশ বেয়ে উড়ে চলেছে, মণিহারী ঘাটের কাছে গঙ্গা পার হবার সময় দেখলুম গঙ্গার চরের কাশ-বনে কি অজস্র কাশফুলের মেলা। খানিকট রেলে খানিকটা পায়ে হেঁটে এলাম কহলগায়ে । গঙ্গার ধারে নির্জন স্থানটি বড় ভাল লাগল। স্টেশনের কাছেই পাহাড়, সামনে যে পাহাড়ট, তার ওপরে ডাক-বাংলো—এখানে একটা রাত কাটালাম। ডাক-বাংলোর কাছে কি চমৎকার এক প্রকার বন্তকুল ফুটেছে, জ্যোৎস্নারাত্রে তার স্বগন্ধে ডাক-বাংলোর বারান্দা আমোদ ক’রে রেখেছে। এক দিন কহলগায়ের খেয়াঘাটে শুনলাম ক্রোশখানেক দূরে গঙ্গার ধারে বটেশ্বরনাথ পাহাড়ে একজন সাধু থাকেন। একখান নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। বটেশ্বরনাথ পাহাড় দূর থেকে দেখেই আমার মনে হ’ল এমন সুন্দর জায়গা আমি কমই দেখেছি, এখানে শাস্তি ও আনন্দ পাব। গঙ্গার ধারে অমুচ্চ ছোট পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় জঙ্গল, নানা ধরনের বুনো গাছ, এক ধরনের হলদে-পাপড়ি বড় বড় ফুল ফুটেছে পেয়ারাগাছের মত গাছে, নাম জানিনে। একটা বড় গুহা আছে পাহাড়ের দক্ষিণ দিকের ঢালুতে জঙ্গলের মধ্যে । গুহার মুখের কাছে প্রাচীন একটা বটগাছ, বড় বড় ঝুরি নেমেছে, ঘন ছায়া, পাকা বটফল তলায় পড়ে আছে রাশি রাশি। সাধুটির সঙ্গে আলাপ হ’ল, বাড়ি ছিল তার মাদ্রাজে, কিন্তু কথাবার্তায় চেহারায় হিন্দুস্থানী। সাধুটি খুব ভাল লোক, লম্বাচওড়া কথা নেই মুখে, বাঙালী বাবু দেখে খুব খাতির করলেন। নিজে কাঠ কুড়িয়ে এনে চা ক'রে খাওয়ালেন, আমার সম্বন্ধে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন—আপনি এখানে যতদিন ইচ্ছে থাকুন, এখানে খরচ খুব কম। আমি এর আগে মুঙ্গেরে কষ্টহারিণীর ঘাটে ছিলাম, শহর বাজার জায়গা, এত খরচ পড়ত যে টিকতে পারলাম না। তাও বটে, আর দেখুন বাবুজী, সাধুরা চিড়িয়ার জাত, আজ এখানে, কাল ওখানে—এক জায়গায় কি ভাল লাগে বেশী দিন ? লোকজন বিশেষ নেই, স্থানটি অতিশয় নির্জন, কথা বলবার লোক নেই, তার প্রয়োজনও বোধ করি নেই বর্তমানে—সারাদিনের মধ্যে সন্ধ্যার সময় সাধুজীর সঙ্গে বসে একটু আলাপ করি। এতদিন কোথাও যে-শাস্তি পাই নি, এখানে তার দেখা মিলেছে, একদিন পাহাড়ের ওপরে বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে একটা মুড়ি-পথ পেলাম। পাহাড়ের গা কেটে পথটা করা হয়েছে, ডাইনে উচু পাহাড়ের দেওয়ালট, বায়ে অনেক নীচে গঙ্গা, ঢাল্টাতে চামেলীর বন, একটা প্রাচীন পুষ্পিত বকাইন গাছ পথের ধারে। কিছুদূর গিয়ে দেখি, পাহাড়ের গায়ে খোদাই-করা কতকগুলো বৌদ্ধ দেবদেবীর মূৰ্ত্তি—গবর্ণমেণ্টের নোটিশ টাঙানো আছে এই মূৰ্ত্তিগুলো কেউ নষ্ট করতে পারবে না ইত্যাদি। আমি জানতাম না এদের অস্তিত্ব। জায়গাটা অতি চমৎকার, স্বৰ্য্যাস্তের সময় সেদিন পীরপৈতির অনুচ্চ শৈলমালার ওপরের আকাশটা লাল হয়ে উঠল, গঙ্গার বুকে আকাশজোড়া রঙীন মেঘমালার ছায়া, খোদাই-করা দেবদেবীর মূৰ্ত্তি গোধূলির চাপা আলোয় কেমন একটা অনির্দেশু শ্ৰী ধারণ করেছে—সে ঐ বড় অদ্ভুত, কোন মূৰ্ত্তির নাক ভাঙী, কোনটার নাক নেই, বেশীর ভাগ মূৰ্ত্তিরই মূখ খসে গিয়েছে—কিন্তু গোধূলির রক্ত-পিঙ্গল আকাশের ছায়ার ঘক্ষিণী যেন জীবন্ত