পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ১২১ ধূসর স্তুপের দিকে চেয়ে, দূর, বহুদূর দিগন্তের দিকে চেয়ে যেখানে বাংলা দেশ, যেখানে মালতী আছে, যেখানে এমন কত মুন্দর বর্ষার সন্ধ্যা মধুর আনন্দে কাটিয়েছি, কত জ্যোৎস্নারাত্রে শুকনে মকাইঝোলানো চালাঘরের দাওয়ার তলায় বসে দুজনে কত গল্প করেছি, তার মুখে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে কতবার অপ্রত্যাশিত মুহূৰ্ত্তে সে এসেছে—আবার কতবার ডাকলেও আসে নি, কতবার চোখাচোথি হ’লেই হেসে ফেলেছে—এ কথা মনে হয়ে অামার মনে কেমন একটা উন্মাদনা, আননা, প্রেম, ভক্তি আরও কত কি ভাবের উদয় হ’ল একটা বড় ভাবের মধ্যে দিয়ে । ওই একটার মধ্যেই সবটা ছিল । তাদের আলাদা আলাদা করা যায় নী—কিন্তু তারই প্রেরণায় আমার আঙুল আপনা-আপনি বেঁকে গেল, গঙ্গার জলে মা, বাবা, হীরু জ্যাঠার নামে তৰ্পণ করলুম, ভগবানের নামে সমস্ত দেহ-মন মুরে এল, জলের ওপরই মাথা নত ক’রে র্তার উদ্দেশে প্রণাম করলুম। সীতার জন্তে করুণ সহানুভূতিতে চোখে জল এল। হঠাৎ ঘোর বৈষয়িকতার জন্তে জ্যাঠামশায়ের প্রতি অনুকম্প হ’ল—আবার সেই স্বষ্টিছাড়া অপরূপ মুহূর্তেই দেখলুম মালতীকে কি ভালই বাসি, মালতীর সহায়হীন, সম্পদহীন ছন্নছাড়া মূৰ্ত্তি মনে ক’রে একটা মধুর স্নেহে তাকে সংসারের দুঃখকষ্ট থেকে বাচাবার আগ্রহে, তাকে রক্ষা করবার, আশ্রয় দেবার, ভালবাসার, ভাল করবার, তার মনে আনন্দ দেবার, তার সঙ্গে কথা বলবার আকুল আগ্রহে সমস্ত মন ভরে উঠল—কি জানি সে মুহূৰ্ত্ত কি ক’রে এল, সেই মেঘান্ধকার বর্ষণমুখর সন্ধ্যাটিতে সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি যেন সেই মহামুহূৰ্ত্তে আমার মধ্যে দিয়ে তার সমস্ত পুলকের, গৌরবের, অনুভূতির সঞ্চয়হীন বিপুল আত্মপ্রকাশ করলে। সেদিন দেখলুম ঈশ্বরের প্রতি সত্যিকার ভক্তির প্রকৃতি মালতীর প্রতি আমার ভালবাসার চেয়ে পৃথক নয়। ও একই ধরনের, একই জাতীয়। যেখানে হৃদয়ের সহানুভূতি নেই, ভালবাসা নেই, সেখানে ঈশ্বরও নেই। ভগবানের প্রতি সেদিন যে-ভক্তি আমার এল—ত এল একটা অপূৰ্ব্ব আনন্দের রূপে—সত্যিকার ভক্তি একটা joy of life“আত্মা, দেহ, মন সেখানে আনন্দে মাধুর্য্যে আপ্লুত হয়ে যায়। ঠিক মালতী আমাকে ভালবেসেছে বা আমি মালতীকে ভালবেসেছি এই ভেবে যেমন হয় তেমনি। কোন পার্থক্য নেই। একই অনুভূতি—দুটো আলাদা আলাদা নাম মাত্র। এতেও মন অবশ হয়ে যায় আনন্দে—ওতেও । উপলব্ধি করে বুঝলুম যদি কেউ আমাকে আগে এসব কথা বলত, আমার কখনই বিশ্বাস হ’ত না । হওয়া সম্ভবও নয় । সাধুজী সন্ধ্যাবেল রোজ ধৰ্ম্মকথা পড়েন । আমি মনে মনে বলি—সাধুজী, আপনি জীবন দেখেন নি। ভালবেসেছেন কখনও জীবনে ? প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছেন ? যে কখনও নরুণ হাতে নিতে সাহস করে নি, সে যাবে তলোয়ার খেলতে । শুকনো বেদান্তের কথার মধ্যে ঈশ্বর নেই—যেখানে ভাব নেই, ভালবাসা নেই, হৃদয়ের দেওয়া-নেওয়া নেই, আপনাকে হারিয়ে ফেলা, বিলিয়ে দেওয়া নেই—সেখানে ভগবান নেই, নেই, নেই । হৃদয়ের খেলা যে আস্বাদ করেছে, ও-রস কি জিনিস যে বোঝে—ভগবানকে ভালবাসার প্রথম সোপানে সে উঠেছে। আমি মালতীর কথা এত ভাবি কেন ? সে আমাকে এত অভিভূত ক’রে রেখেছে কেন দিন, রাত, সকাল, সন্ধ্যা ?...এই বিক্রমশিলা বিহারের পাহাড়মাল, বন-শ্রেণী পাদমূলে প্রবাহিত পুণাস্রোতা নদী, সন্ধ্যার পটে রাঙা স্বৰ্য্যাস্ত, বনচামেলীর উগ্র উদাস গন্ধ—এসবের মধ্যে সে আছে, তার হাসি নিয়ে, তার মুখভঙ্গি নিয়ে, তার গলার মুর নিয়ে, তার শতসহস্ৰ টুকরো কথা নিয়ে, তার ছেলেমান্থষি ভঙ্গি নিয়ে। কেন তাকে ভুলি নি, কেন তার জন্ত আমার মন সৰ্ব্বদাই উদাস, উন্মুখ, ব্যাকুল, বেদনার ভর, স্থতির মাধুর্ষ্যে আপ্লত, নিরাশায়