পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

* १९ বিভূতি-রচনাবলী যন্ত্রণাময়—হঠাৎ তাকে এত ভালবাসলুম কেন ? তার কথা মনে যখন আসে, তখন কেওলিন খনির উপরকার পাহাড়চূড়াটায় একটা বকাইন গাছের গুড়িতে ঠেস্ দিয়ে সারাদিন তার কথা ভাবি–খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে থাকে না, ভালও লাগে ন-তার মুখের হাসির স্থতিতেই যেন আমার শান্তিময় নিভৃত গৃহকোণ, তার কথার স্বর দূরের ব্যবধান ঘুচিয়ে, মাঠ নদী বন পাহাড় পার হয়ে ভেসে এসে আমার প্রদীপ-জালানো শাস্ত আঙিনায় ছোট খড়ের রান্নাঘরের একপাশে উপবিষ্ট নিরীহ গৃহস্থ সাজায়—জীবনে তাই যেন চেয়ে এসেছি, সব দুরাশ, সব-কিছু ভূলিয়ে দেয়, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়.এদিকে রোদ চড়ে ওঠে কিংবা স্বৰ্য্য চলে পড়ে, বটেশ্বরনাথের পাহাড় রঙে রঙে রাঙা হয়, পার্থীর গান হঠাৎ যায় থেমে— সাধুজীর চেলা বৰ্খানারায়ণ আমাকে খুঁজতে আসে চা খাবার জন্তে”তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হয় “গাজার ধোয়ায় অন্ধকার সাধুবাবাজীর গুহার সামনে বসে দুধবিহীন কড়া চ খেতে খেতে হকুমান-চরিত শুনতে হয় । সাধুজী আমাকে ভালবাসেন। এই জন্তে ওঁর এখানে আছি। এখানে পয়সার খরচ নেই বললেই হয়। বারোটা টাকা এনেছিলুম, সাধুজীর হাতে তুলে দিয়েছি—নিতে চান নি— আমি পীড়াপীড়ি ক’রে দিয়েছি। একবেল খাই মকাইয়ের ছাতু, একবেল রুটি আর টেডুসের তরকারি। অন্ত কিছু এখানে মেলে না। কেওলিন খনির ম্যানেজার মাঝে মাঝে কহলগাও থেকে মাছ আনায়, সেদিন ওর বাংলোতে আমায় খেতে বলে—কারণ সাধুর এখানে ওসব করবার হবার জো নেই। মালতীর সঙ্গে আবার দেখা হবে না ? কিন্তু কি ক’রে হবে তা তো বুঝি নে। আমি আবার সেখানে কোন ছুতোয় যাবো? উদ্ধবদাস-বাবাজী আমার ভাল চোখে দেখতে না। দু-একবার অসন্তোষ প্রকাশও করেছিল, মালতীর সঙ্গে যখন বড় মিশছি—তখন দু-একবার আমায় এমন আভাসও দিয়েছিল যে এখানে বেশী দিন থাকলে ভাল হবে না। ও-সবে আমি ভয় করি নে। সপ্তসিন্ধুপারের দেশ থেকে মালতীকে আমি ছিনিয়ে আনতে পারি, যদি আমি জানতাম যে মালতীও আমায় চায়। কিন্তু তাতে আমার সন্দেহ আছে। সেই সন্দেহের জন্তেই যত বেদন, যাঁ-কিছু যন্ত্রণা! কি জানি, বুঝতে পারি নে সবখানি। রহস্যময়ী মালতীর মনের খবর পুরো এক বছরেও পাই নি । এক-একবার কিন্তু আমার মনের গভীর গোপন তল থেকে কে বলে, অত সন্দেহ কেন তোমার মনে ? তোমার চোখ ছিল কোথায় ? মালতীকে বোঝ নি এক বছরেও ? মালতী—কি মাধুর্য্যের রূপ ধরেই সে মনে আসে। তার কথা যখনই ভাবি, অন্ত-আকাশের অপরূপ শোভায় পাহাড়ের ধূসর ছায়ায় গঙ্গার কলতানের মধ্যে ওপারের খাসমহলের চরে কলাইওয়ালী মাথায় কলায়ের বোঝা নিয়ে ঘরে যখন ফেরে, যখন সাদা পাল তুলে বড় বড় কিস্তি কহলগায়ের ঘাট থেকে বাংলা দেশের দিকে যায়...কিংবা যখন গঙ্গার জলে রঙীন মেঘের ছায়া পড়ে, খেয়ার মাঝিরা নিজেদের নৌকোতে বসে বিকট চীৎকার করে ঠেট, হিন্দীতে ভজন গায়—সমস্ত পৃথিবী, আকাশ, পাহাড় একটা নতুন রঙে রঙীন হয়ে ওঠে আমার মনে—ওই দূর বাংলাদেশের এক নিভৃত গ্রামের কোণে মালতী আছে, যখন আবার বর্ষ নামে, খুব ঝড় ওঠে, কিংবা পুকুরের ঘাটে এক গা ধুতে যায়, কি বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দেখায় সন্ধ্যায়—আমার কথা তার মনে পড়ে না ? আমার তো পড়ে—সব সময়ই পড়ে, তার কি মনে পড়ে না ? মালতীকে নিয়ে মনে কত ভাঙা-গড়া করি, কত অবস্থায় দুজনকে ফেলি মনে মনে, কত বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করি, আমার অমুখ হয়, সে আমার পাশে বসে না ঘুমিয়ে সারারাত