পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

}\08 বিভূতি-রচনাবলী অচৈতষ্ঠ হয়ে বিছানার শুয়ে, ছেলেমেয়েরা যা খুশী তাই করচে, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙছে, ফেলছে, ছড়াচ্ছে—এখানে নোংরা, ওখানে অপরিষ্কার—কোন জিনিস কোথায় থাকে কেউ বলতে পারে না, হঠাৎ অসময়ে আবিষ্কার করি, ঘড়ায় খাবার জল নেই, কি লণ্ঠন জালাবার তেল নেই। বাজার নিকটে নয়, অন্ততঃ দেড় মাইল দূরে এবং বাজারে যেতে হবে আমাকেই। সুতরাং বেশ বোঝা যাবে অসময়ে এসব আবিষ্কারের অর্থ কি । প্রায় এক মাস এই ভাবে কাটল । এই এক মাসের কথা ভাবলে আমার ভয় হয়। আমি জানতুম না কখনও যে জগতে এত দুঃখ আছে বা সংসারের দায়িত্ব এত বেশী। রাত দিন কখন কাটে ভুলে গেলাম, দিন, বার, তারিখের হিসেব হারিয়ে ফেলেছিলুম—কলের পুতুলের মত ডাক্তারের কাছে যাই, রোগীর সেবা করি, চাকরি করি, ছেলেমেয়েদের দেখা-শুনো করি। এই দুঃসময়ে দাদার আট বছরের মেয়েটা আমাকে অদ্ভূত সাহায্য করলে। সে নিজে রাধে, মায়ের পথ্য তৈয়ারী করে, মায়ের কাছে বসে থাকে—আমি যখন কাজে বেরিয়ে যাই ওকে ব’লে যাই ঠিক সময় ওষুধ খাওয়াতে, কি পথ্য দিতে । মেজাজ আমার কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়, একদিন কোথা থেকে এসে দেখি রোগিণীর সামনের ওষুধের মাসে ওষুধ রয়েছে। খুকীকে বলে গিয়েছি খাওয়াতে কিন্তু সে ওষুধ গ্লাসে ঢেলে মায়ের পাশে রেখে দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। দেখে হঠাৎ রাগে আমার আপাদমস্তক জলে উঠল আর ঠিক সেই সময় খুকী আঁচলে কি বেঁধে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। আমি রুক্ষ মুরে বললাম—খুকী, এদিকে এস— আমার গলার মুর শুনে খুকীর মুখ শুকিয়ে গেল ভয়ে। সে ভয়ে ভয়ে দু-এক পা এগিয়ে আসতে লাগল, বরাবর আমার চোখের দিকে চোখ রেখে । আমি বললাম—তোর মাকে ওষুধ খাওয়াস নি কেন ? কোথায় বেরিয়েছিলি বাড়ি থেকে । সে কোন জবাব দিতে পারল না—ভয়ে নীলবর্ণ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইল । হঠাৎ কি যে রাগ হ’ল চণ্ডালের মত ! তাকে পাখার বাট দিয়ে আথালি-পাথালি মারতে লাগলাম—প্রথম ভয়ে মার খেয়েও সে কিছু বললে না, তার পরে আমার মারের বহর দেখে সে ভয়ে কেঁদে উঠে বললে—ও কাকাবাবু, আপনার পায়ে পড়ি, আমায় আর মারবেন না, আর কখনও এমন করবো নী— তার হাতের মুঠে আলগা হয়ে আঁচলের প্রান্ত থেকে দুটো মুড়ি পড়ে গেল মেঝেতে । সে মুড়ি কিনতে গিয়েছিল এক পয়সার, খিদে পেয়েছিল ব'লে। ভয়ে তাও যেন তার মনে হচ্ছে কি অপরাধই সে ক’রে ফেলেছে! আমার জ্ঞান হঠাৎ ফিরে এল। মুড়ি ক'টা মেঝেতে পড়ে যাওয়ার ঐ দৃশ্বে বোধ হয়। নিজেকে সামলে নিরে ঘর থেকে বার হয়ে গেলাম। সমস্ত দিন ভাবলাম—ছি, এ কি ক’রে বসলাম! আট বছরের কচি মেয়েট সারাদিন ধরে খাটছে, এক পয়সার মুড়ি কিনতে গিয়েছে আর তাকে এমনি ক’রে নির্মমভাবে প্রহার করলাম কোন প্রাণে ? জীবনে কত লোকের কত বিচার করেছি তাদের দোষগুণের জন্তে—দেখলাম কাউকে বিচার করা চলে না—কোন অবস্থার মধ্যে পড়ে কে কি করে সে কথা কি কেউ বুঝে দেখে ? বৌদিদির অমুখ ক্রমে অত্যন্ত বেড়ে উঠল। দিন-দিন বিছানার সঙ্গে মিশে যেতে লাগল দেখে ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে যাচ্ছে। এদিকে এক মহা দুশ্চিন্তা এসে জুটল, যদি বৌদিদি নাই বাচে—এই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি কি করব ? বিশেষ ক’রে কোলের মেয়েটাকে নিয়ে কি করি ? ছোট্ট খুকী মোটে এই দশ মাসের—কি সুন্দর গড়ন,