পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ లి(t মুখ, কি চমৎকার মিষ্টি হাসি! এই দেড় মাস তার অযত্বের একশেষ হচ্ছে—উঠোনের নারকোলতলায় চটের থলে পেতে তাকে রোদরে শুইয়ে রাখা হয়—বড় খুকী সব সময় তাকে দেখতে পারে ন!—কাদলে দেখবার লোক নেই, মাতৃস্তম্ভ বন্ধ এই দেড় মাস– হলিক্স খাইয়ে অতি কষ্টে চলছে। রাত্রে আমার পাশে তাকে শুইরে রাখি, মাঝরাত্রে উঠে এমন কান্না শুরু করে মাঝে মাঝে—ঘুমের ঘোরে উঠে তাকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াই— বড় খুকীকে আর ওঠাই নে। রাত্রে তো প্রায়ই ঘুম হয় না, রোগীকে দেখা-শুনো করতেই রাত কাটে—মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। পাড়ায় এত বেী-ঝি আছে—দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম কেউ কোনদিন বলে না খুকীকে নিয়ে গিয়ে একবার মাইয়ের দুধ দিই। আমি এক কত দিকে যাব—তা ছাড়া আমার হাতের পয়সাও ফুরিয়েছে। এই দেড় মাসের মধ্যে সংসারের রূপ একেবারে বদলে গিয়েছে আমার চোখে—আমি ক্রমেই আবিষ্কার করলাম মানুষ মানুষকে বিনাস্বার্থে কখনও সাহায্য করে না—আমি দরিদ্র, আমার কাছে কারুর কোন স্বার্থের প্রত্যাশা নেই, কাজেই আমার বিপদে কেউ উকি মেরেও দেখতে এল না । না আমুক, কিন্তু কোলের খুকীটাকে নিয়ে যে বড় মুশকিলে পড়ে গেলাম! ও দিন-দিন আমার চোখের সামনে রোগ হয়ে যাচ্ছে, ওর অমন কঁচা সোনার রঙের ননীর পুতুলের মত ক্ষুদে দেহটিকে যেন কালি মেড়ে দিচ্ছে দিন-দিন—কি করবো ভেবে পাই নে, আমি একেবারেই নিরুপায় ! স্তম্ভদুগ্ধ আমি ওকে দিতে তো পারি নে ! কিন্তু এর মধ্যে আবার মুশকিল এই হ’ল যে স্তন্যদুগ্ধ তো দূরের কথা, গরুর দুধও গ্রামে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল । গোয়ালার ছানা তৈরি করে কলকাতায় চালান দেয়, দুধ কেউ বিক্রী করে না । একজন গোয়ালার বাড়িতে দুধের বন্দোবস্ত করলাম—সে বেলা বারোটাএকটার এদিকে দুধ দিত না। খুকী ক্ষিদেতে ছট্‌ফট্‌ করত, কিন্তু চুপ ক’রে থাকত—একটুও কাদত না। আমার বুড়ো-আঙুলটা ধরে তার মুখের কাছে সে সময় ধরলেই সে কচি অসহায় হাত দুটি দিয়ে আমার আঙলটা ধরে তার মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে ব্যগ্র, ক্ষুধাত ভাবে চুত—তা থেকেই বুঝতাম মাতৃস্তন্ত-বঞ্চিত এই হতভাগ্য শিশুর স্তম্ভক্ষুধার পরিমাণ । | ওকে কেউ দেখতে পারে না—দু-একটি পাড়ার মেয়ে যার বেড়াতে আসত, তার ওকে দেখে নানা রকম মন্তব্য করত । ওর অপরাধ এই যে ও জন্মাতেই ওর বাবা মারা গেল, ওর মা শক্ত অমুখে পড়ল। খুকীর একটা অভ্যাস যখন-তখন হাসা—কেউ দেখুক আর নাই দেখুক, সে আপন মনে ঘরের আড়ার দিকে চেয়ে ফিক্‌ ক’রে একগাল হাসবে । তার সে ক্ষুধাশীর্ণ মুখের পবিত্র, মুনীর হাসি কতবার দেখেছি—কিন্তু সবাই বলত, আহা কি হাসে, আর হাসতে হবে না, কে তোমার হাসি দেখছে ? উঠোনের নারকোলতলায় চট পেতে রৌদ্রে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, কত দিন দেখেছি নীল আকাশের দিকে চোখ দুটি তুলে সে আপন মনে অবোধ হাসি হাসছে। সে অকারণ, অপার্থিব হাসি কি অপূৰ্ব্ব অর্থহীন খুশিতে ভরা! ছোট দেহটি দিন-দিন হাড়সার হয়ে যাচ্ছে, অমন সোনার রং কালো হয়ে গেল, তবুও ওর মুখে সেই হাসি দেখছি মাঝে মাঝে—কেন হাসে, কি দেখে হাসে কে বলবে ? এক এক দিন রাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি ও খুব চেচিয়ে কাদছে। মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। বড় খুকীকে বলতাম—একটু দ্বধ দে তো গরম করে, হরত খিদেয় কাদছে। সব দিন আবার রাত্রে দুধ থাকত না। সেদিন আজুল চুযিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়াতে হত। একদিন সকালে ওর কান্না দেখে আর থাকতে পারলাম নী—রোগীর সেবা ফেলে ছক্রোশ তকাতের একটা গ্রাম থেকে নগদ পয়সা দিয়ে আধলের দ্বধ যোগাড় করে নিয়ে