পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ১৩৭ কিন্তু বড় কষ্ট পেয়ে গেল। কিছুই সে চায় নি, শুধু একটু মাতৃপ্তম্ভ, কি লোলুপ হয়ে উঠেছিল তার জন্তে, তার ক্ষুদে ক্ষুদে হাত দুটি দিয়ে ব্যগ্রভাবে আমার আঙুলটা আঁকড়ে ধরে কি অধীর আগ্রহে সেটা চুষত মাতৃস্তন ভেবে । আমারও কি কম কষ্ট গিয়েছে অবোধ শিশুকে এই প্রতারণা করতে ? জগতে কত লোক কত সঙ্গত অসঙ্গত খেয়াল পরিতৃপ্ত করবার সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে, আর একটি ক্ষুদ্র অস্ফুটবাক্ শিশুর নিতান্ত স্তায্য একটা সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল কেন তাই ভাবি । | >や | বৌদিদি ক্রমে সেরে উঠলেন । কিছুদিন পরে আমার হঠাৎ একদিন জর হ’ল। ক্রমে জর বেঁকে দাড়াল, আমি অজ্ঞান-অচৈতন্ত হয়ে পড়লাম। দিনের পর দিন যায়, জর ছাড়ে না। একুশ দিন কেটে গেল। দিনের রাতের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি যেন, কখন রাত কখন দিন বুঝতে পারি নে সব সময় । মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখি বাইরের রোদ একটু একটু ঘরে এসেছে, তখন বুঝি এটা দিন। বিছানার ওপাশটা ক্রমশঃ হয়ে গেল বহুদূরের দেশ, আফ্রিকা কি জাপান, ওখানে পৌছনে আমার শরীর ও মনের শক্তির বাইরে । অধিকাংশ সময়ই ঘোর-ঘোর ভাবে কাটে—সে অবস্থায় যেন কত দেশ বেড়াই, কত জায়গায় যাই । যখন যাই তখন যেন আর আমার অমুখ থাকে না, সম্পূর্ণ মুস্থ, আনন্দে মন ভরে ওঠে, রোগশয্যা স্বপ্ন বলে মনে হয় । ছেলেবেলাকার সব জায়গাগুলোতে গেলাম যেন, আটঘরার বাড়িও বাদ গেলো না । হঠাৎ ঘোর কেটে যায়, দেখি কুলদা ডাক্তার বুকে নল বসিয়ে পরীক্ষা করছে। একবার মনে হ’ল দুপুর বী-বী করছে, আমি দ্বারবাসিনীতে যাচ্ছি খুকীকে কোলে নিয়ে। দুর্গাপুরের ডাঙা পার হয়ে গেলাম, আবার সেই কাদোড় নদী, সেই তালবন, রাঙামাটির পথ। মালতী বড় ঘরের দাওয়ায় বসে কি কাজ করছে । উদ্ধবদাস আমার দেখে চিনলে, কাছে এসে বললে—বাবু যে—কি মনে ক’রে এতদিন পরে ? আপনার কোলে ও কে ? মালতী কাজ ফেলে মুখ তুলে দেখতে গেল উদ্ধবদাস কার সঙ্গে কথাবাৰ্ত্তী কইছে। তারপর আমায় চিনতে পেরে অবাক ও আড়ষ্ট হয়ে সেইখানেই বসে রইল। আমি এগিয়ে দাওয়ার ধারে গিয়ে বললাম —তুমি কি ভাববে জানিনে মালতী, কিন্তু আমি বড় বিপদে পড়েই এসেছি। এই ছোট খুকী আমার দাদার মেয়ে, এর মা সম্প্রতি মারা গিয়েছে। একে বাচিয়ে রাখবার কোন ব্যবস্থা আমার মাথায় আসে নি। আর আমার কেউ নেই—একমাত্র তোমার কথাই মনে হ’ল, তাই একে নিয়ে তোমায় কাছে এসেছি। একে নাও, এর সব ভার আজ থেকে তোমার ওপর । তুমি ছাড়া আর কারও হাতে একে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব না। মালতী তাড়াতাড়ি খুকীকে আমার কোল থেকে তুলে নিলে। তারপর আমার রক্ষ চুল ও উদভ্ৰাস্ত চেহারার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরক্ষণেই সে দাওয়া থেকে নেমে এসে বললে—আপনি আমুন, উঠে এসে বসুন । আখড়ায় আর যেন কেউ নেই। উদ্ধবদাসকে আর দেখলাম না। শুধু মালতী আর আমি । ও ঠিক সেই রকমই আছে—সেই হাসি, সেই মুখ, সেই ঘাড় বাকিয়ে কথা বলার ভঙ্গি । হেসে বললে—তারপর ? আমি বললাম—তারপর আর কি ? এই এলাম।