পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ 》84 তো ? ও রাধছে বসে, আমাকে রান্নাঘরেই বসে থাকতে হ’ল—ও যেতে দেয় না, ছেলেমানুষ, ভয় করে। কেবল জিজ্ঞেস করে, মা আর দিদির কি হবে । রান্না হয়ে গেল, ঠাই ক’রে আমায় ভাত বেড়ে দিলে। এদিকে হিরণ বড় অগোছালো, কুটনো-বাটনা, এটো-কঁাটা, ভাতের ফেন, আনাজের খোসাতে রান্নাঘর এমন নোংরা ক’রে তুলেছে ! ভাত বাড়তে গিয়ে উকুনের পাড়ে আঁচল লুটিয়ে পড়েছে—নিতান্ত আনাড়ি। বললাম—দিনমানে কোন রকমে একা থেকে । আমি সন্ধ্যের আগেই রাণাঘাট থেকে ফিরবো। রোধে থেও কিন্তু । না হ’লে বড় রাগ করব । মোহিনী কাওরাণী এল রাত ন’টার পরে। তার পরে আমি আমার বাসায় চলে এলুম। পরদিন রাণাঘাটে গিয়ে দেখি কেস ওঠে নি আদালতে। উকীল ঠিক ক'রে তার সঙ্গে জামিনের কথাবাৰ্ত্ত বলে এলুম। ফিরবার সময় হিরন্ময়ীর জন্তে দু-একটা জিনিস কিনে নিলুম ওকে একটু আনন্দ দেবার জন্তে। ফিরে দেখি ও বসে বসে আবার কাদছে কালকের মত । সারাদিন বোধ হয় রাধে নি, কিছু খায় নি। স্নানও করে নি, দু-এক গাছ রুক্ষ চুল মুখের আশেপাশে উড়ছে। মহা বিপদে পড়ে গেলুম ওকে নিয়ে। কি করি এখন ? ওর বাবাকে আজ রাণাঘাটে পৌঁছেই টেলিগ্রাম করেছি, যদি তা পেয়ে থাকেন, তবে কাল তিনি এসে পৌছলেও তো বাচি। নইলে হিরন্ময়ীকে ভাবছি কালীগঞ্জে বৌদিদির কাছে রেখে আসব। কারণ, এসে শুনলুম মোহিনী বুড়ী ব’লে গিয়েছে সে রাত্রে এখানে আর শুতে আসতে পারবে না । ও আমায় দেখেই ছুটে এসে বললে—মাকে দিদিকে দেখে এলেন মাস্টার মশাই ? তারা কেমন আছে ? খালাস পেলে না ? আমি ওদের নিজে দেখতে যাই নি, উকীলের মুখে হিরন্ময়ীর সংবাদ পাঠিয়ে বলেছিলুম হিরন্ময়ীর জন্যে যেন তারা কিছু না ভাবে । বললাম সেকথা। তার পর হিরন্ময়ী আমাকে বালতি ক’রে জল তুলে দিলে স্নানের জন্তে—ঘরে প্রদীপ জেলে উকুন ধরিয়ে চায়ের জল চড়ালে। রাণাঘাট থেকে ওর জন্যে কিছু খাবার এনেছিলুম, তার বেশী অৰ্দ্ধেক আমায় রেকাবি ক’রে চায়ের সঙ্গে জোর করে খাওয়ালে—তার পর রান্না চাপিয়ে দিলে। ওর মনে মুখ নেই, কেমন যেন মুষড়ে পড়েচে, ছেলেমানুষ, নইলে ওর মত হাস্যময়ী আনন্দময়ী চঞ্চল মেয়ে এতক্ষণ কত কথা বলত, হাসি-খুশীতে ঘর ভরিয়ে তুলত। একবার জিজ্ঞেস করলে—রাণাঘাটে নাকি সার্কাস এসেছে সবাই বলে? দেখেছেন আপনি ? এত দুঃখের মধ্যেও ওর ছেলেমাহুষি মন সার্কাসের সম্বন্ধে কৌতুহলী না হয়ে পারে নি ভেবে আমার হাসি পেল । এ রাত্রে মোহিনী বুড়ী এল না—আমি ওকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরের বারানাতে শুয়ে রইলাম। বারান্দায় বিছানা পাতছি, ও আবার এত সরলা নিষ্কলুষ—আমার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাইরে শোবেন কেন ? কোন নীতিবাদের সঙ্কোচ এনে ফেলে ওর নিষ্পাপ মনে দাগ দিতে আমার বাধল। বললাম —দেখছ না কি রকম গরম আজ ? বাইরে শোওয়াই আমার অভ্যেস, তা ছাড়া— । সারারাত দু-জনে গল্প ক'রে কাটালুম। ও ঘর থেকে কথা বলে, আমি বারানা থেকে তার উত্তর দিই –বাবা বোধ হয় কাল আসবেন, না 7 মা, দিদি কবে আসবে ? সার্কাসওয়াল কোথায় তাবু ফেলেছে ? কলকাতায় কখনও যাই নি—একবার যাবার ইচ্ছে আছে। কলকাতার থিয়েটার দেখতে কেমন? চৌধুরীরা বোধ হয় মোহিনী বুড়ীকে বারণ করে দিয়েছে এখানে