পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

X6 o বিভূতি-রচনাবলী এর কিছুদিন পরে হিরন্ময়ীর বাবা আমার কাছে এলেন কালীগঞ্জে। অামায় একবার তাদের ওখানে যেতে হবে, হিরন্ময়ী বিশেষ ক'রে বলে দিয়েছে । আর একটা কথা, মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি বড় বিপদে পড়েছেন । তিনি গরীব, অবস্থা আমি সবই জানি, গ্রামের সমাজে একঘরেও বটে। দু-তিন জায়গা থেকে সম্বন্ধ এসেছিল, নানা কানাযুষে শুনে তারা পেছিয়ে গিয়েছে। মেয়েও বেজায় একগুঁয়ে, তাকে দেখতে আসছে শুনলেই সে বাড়ি থেকে পালায় । অত বড় মেয়ে, এখনও জ্ঞান-কাণ্ড হ’ল না, চিরকাল কি ছেলেমাতুষি করলে মানায় ? সুতরাং তিনি বড় বিপদে পড়েছেন, আমি যদি ব্রাহ্মণের এ দায় উদ্ধার না করি তবে তিনি, কালীকান্ত গাঙ্গুলী, সম্পূর্ণ নিরুপায়। আমার কি মত? আমি আর কিছুই ভাবলাম না, ভাবলাম কেবল হিরন্ময়ীর আশাভাঙা চোখের চাউনি আর তার শুকনো মুখ, সেদিন যখন জিনিসপত্র বাধছি সেই সময়কারের। একদিন হিরন্ময়ী বললে—একটা কথা শোন। যেদিন তুমি প্রথম পাঠশালাতে পড়াতে এলে, আমি তোমার কাছে গেলাম, সেদিন থেকে তোমায় দেখে আমার কেমন লজ্জা করত । সেই জন্তে কাছে বসতে চাইতাম না। তার পর তুমি একদিন রাগ করলে, তাতে আমারও খুব রাগ হ’ল। তুমি তার পর বললে—আমাদের গা ছেড়ে চলে যাবে। সেদিন ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গেল। এত কান্না আসতে লাগল, কান্না চাপতে পারি নে, পাছে কেউ টের পায়, ছুটে পেছনের সজনেতলায় চলে গেলাম। সব যেন ফাকা হয়ে গেল মনের মধ্যে। উঃ মাগে, সে যে কি দিন গিয়েছে ! হিরণায়ী গুছিয়ে কথা বলতে শেখে নি এখনও । ভগবান জানেন বিয়ের সময় কেমন যেন অন্তমনস্ক হয়ে গিয়েছিলুম। সপ্তসমুদ্র পারের কোন দেশে অনেক দূরে এই সব সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে একটি হাস্যমুখী তৰী কিশোরী প্রদীপ হাতে ভাঙা বিষ্ণুমন্দিরে সন্ধ্যা দেখাতে যেত কত যুগ আগে-পুকুরপাড়ের তমালবনের আড়ালে তার সঙ্গে সেই যে সব কত সুখ-দুঃখের কাহিনী, কত ঠাকুর-দেবতার কথা, সে সব সত্যি ঘটেছিল, ন। স্বপ্ন ? কোথায় গেল সে মেয়েটি ? আর তাকে তেমন ক’রে তো চাই না ? যেন কত দূর-জন্মে তার সঙ্গে সে পরিচয়ের দিনগুলো কালের কুয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে—তাকে যেন চিনি, চিনি, চিনি না । কেন তার স্মৃতিতে মন আর নেচে ওঠে না ? কোথায় গেল সে-সব দিন, সে-সব প্রদীপ-দেখানে সন্ধ্যা ? বছরখানেক পরে একদিন রাণাঘাট স্টেশনের প্ল্যাটফর্শ্বে দাড়িয়ে আছি। মুর্শিদাবাদের ট্রেন থেকে অনেকগুলো বৈষ্ণব নামলো। তারা যাবে খুলনার গাড়িতে। তাদের মধ্যে একজনকে পরিচিত বলে মনে হ’ল। কাছে গিয়ে দেখি দ্বারবাসিনীর আখড়ার সেই নরহরি বৈরাগী—যে একবার জীবগোস্বামীর পদাবলী গেয়েছিল। সে পয়লা নম্বরের ভবঘুরে, মাঝে মাঝে আখড়ায় আসত, আবার কোথায় চলে যেত। নরহরিও আমার চিনলে, প্রণাম ক’রে বললে—এখানে কোথায় বাৰু? এটা কি দেশ নাকি ? আপনি তো অনেক দিন দ্বারবাসিনী যান নি ? আর যাবেনই বা কি, সব শুনেছেন বোধ হয়, আখড়া আর সে আখড়া নেই। দিঠিাকৃঙ্কণ মারা যাওয়ার পরে— →কে ?