পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ Ꮌ©Ꮌ —কেন আপনি জানেন না ? মালতী দিদিঠাকুরুণ তো আজ বছর চারেক মারা গিয়েছেন । আমি ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলুম। নরহরি আপন মনেই বলে যেতে লাগল—এখন উদ্ধবদাসের এক ভাইপো তার সেবাদাসী নিয়ে কোথা থেকে এসে জুটেছে। সে-ই এখন কৰ্ত্ত । উদ্ধবদাস তো বুড়ো হয়েছে, সে কিছু দেখে-শোনে না। এখন অতিথি-বোষ্টম গেলে আর জায়গা হয় না। মালতী দিদিঠাকুরুণ তো মানুষ ছিলেন না, স্বর্গের দেবী ছিলেন, কি বাপের মেয়ে ! তিনি স্বর্গে চলে গিয়েছেন, এখন তার অত সাধের আখড়ার কি দশা হয়েছে এই চার বছরে, দেখে চোখে জল আসে বাবু। তাই বড়-একটা সেখানে যাই নে। ওরা চলে গেলে আমি স্টেশনের বাইরে সেগুনবাগানে গিয়ে কতক্ষণ ব’সে রইলাম । কতক্ষণ-কতক্ষণ । হিসেব ক’রে দেখলাম আমি যখন বটেশ্বরনাথ পাহাড়ে তখনই সে মারা গিয়েছে। অর্থাৎ আমি আখড়া ছেড়ে আসবার এক বছর পরেই। আজ হঠাৎ মনে হ’ল তার ওপর কি সুবিচার করেছিলুম ? অভিমান ভাঙবার সুযোগও তাকে আর একবার দিই নি । আমার জীবনে সে মরে গিয়েছে অনেক দিন, যদিও খবরটা আজ পেলাম ! আমার মন অলক্ষিতে আত্মরক্ষণ করেছে, বেদনার স্থানে শক্ত আবরণ গড়ে তুলেছে—শামুক যেমন আত্মরক্ষার জন্তে খোলা তৈরি করে। আজ সে "খোলা হয়ে পড়েছে শক্ত অনুভূতিহীন—অন্ততঃ এতদিন তাই ভাবতাম। কিন্তু খোলার আবরণের তলায় ব্যথার জায়গাটা আজ মনে হচ্ছে একেবারে সম্পূর্ণরূপে সারে নি। কে আজ উত্তর দেবে—আমি চলে এলে গোপনে একটুখানি চোখের জলও কি ফেলে নি সে কোনদিন ? বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দিতে গিয়ে কখনো একদিনও কি অন্তমনস্ক হয় নি ? দিনের কাজ মিটে গেলে সে যখন ‘পাষণ্ড-দলনের অনুকরণে বই লেখবার উদ্দেশ্য নিয়ে তার সেই খাতাখানা খুলে বসত, একদিনও কি আমার কথা মনে পড়ে নি ? “কত ঠাট্ট যে করতুম তার সেই বই লেখা নিয়ে । আমার যদি আজ দশ হাজার টাকা থাকত, আমি চাইলেই সব টাকাই দিয়ে দিতে পারতাম, যদি এই খবরগুলো আমার কেউ দিতে পারতো। টাকার মায়া করতুম ন—করি নি কোনদিন । এই খবরের বদলে আমি কি না দিতে পারি। পাগলের মত কি ভাবছি য'ত বসে ! লাভ কি আজ এসব ভাবনার ? ভালই হয়েছে মালতী, তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। সুন্দর জ্যোৎস্নারাতে পল্লীপ্রান্তের বনে মরচে-লতায় ফুল ফোটে, সুবাসে পথচারীদের মন আনন্দে ভরিয়ে তোলে কিন্তু কতদিন তার আয়ু ? জ্যোৎস্ব লুকিয়ে আঁধার পক্ষ নামে, বনফুল ঝরে যায়, পুপমুরভি হিমের রাত্রির ঘন কুয়াশায় চাপা পড়ে, নয়ত অকাল বর্ষার বারিধারার ধুয়ে মুছে যায়। মানুষের অনেক সেবা তুমি করেছিলে, মানুষের মনে তোমার রূপ ভগবান মান হ'তে দিলেন না। ফুলের সুবাস চলে গেলে বনলত পাছে অনাদৃত হয় ! তোমার বেলা ভগবান তা সহ করবেন না । সেগুনবাগান থেকে উঠে এলুম, তখন রাত হয়ে গিয়েছে। একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল। একবার মালতীকে বলেছিলুম—আমাদের গায়ে একটা হাতভাঙা বিষ্ণুমূৰ্ত্তি আছে। ছেলেবেলায় তাকে বড় ভালবাসতুম। ভগবান যদি দিন দেন, তাকে নিরে এসে তোমার বাবার মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করব । দেখতে দেখতে কত দিন হয়ে গেল । তার পর সাত-আট বছর কেটে গিয়েছে।••• আমার সে অল্প বয়সের ভবঘুরে জীবনের পূচ্ছেদ পড়েছে অনেক দিন। তবু সেসব