পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৬২ বিভূতি-রচনাবলী —কোথায় আপনার বাড়ি ? —সে তুমি চিনতে পারবে না, সে অনেক দূর । এইভাবে আলাপের স্বত্রপাত। তারপর কতদিন সকালে বিকালে প্রমো আসিত, কোন দিন ওলের ডাট, কোন দিন ডুমুর, কোন দিন বা একটা চালত, নিজে যা বনে জঙ্গলে সংগ্ৰহ করিত, তার কিছু ভাগ আমার না দিয়া তার যেন তৃপ্তি হইত না। মাঝে মাঝে ওইখানটায় দাড়াইয়া চালের বাত ধরিয়া কত গল্প করিত। সরলা বালিকা কাঠ কুড়াইয়া, শাকপাত সংগ্ৰহ করিয়া তার দরিদ্র মায়ের গৃহস্থালীর অভাব দূর করিতে চেষ্টা করিত, তেমনই এই দরিদ্র ডাক্তারের প্রতি গভীর অনুকম্পাবশতঃ তার ভাতের থালার উপকরণও জুটাইয়া দিত। বড় ভাল লাগিত তাকে। একটা অদৃশু সহানুভূতির স্বত্রে সে আমাকে বধিয়াছিল এবং বোধ হয় আমিও তাকে বাধিয়াছিলাম। পলাশপুরের হাটতলায় নিঃসঙ্গ জীবনে একটি মমতাময়ী নারীর সঙ্গ বোধ হয় খুব ভালই লাগিয়াছিল। তাই সে আসিলে মনটা খুশী হইয়া উঠিত। ইদানীং সে আসিতও ঘন ঘন, নানা ছলছুতায়, কারণে অকারণে আসিয়া থেইহার কথাবাৰ্ত্তায় থাকিয়া যাইতও অনেকক্ষণ । \ একদিন লক্ষ্য করিলাম, প্রমে তার বেশভূষার দিকে নজর দিয়াছে। প্রথম সেদিন তার যত্ব করিয়া বাধা খোপাটির দিকে চাহিয়া আমার এ কথা মনে হইল। ফর্সা শাড়িখানা পরিপাটী করিয়া পরিতে শিথিয়াছে। মুখের হাসির মধ্যে একদিন সলজ্জ সঙ্কোচের ভাব দেখিলাম, যে ধরণের হাসি তার মুখে নতুন। আর কত ভাবেই সেবা করিতে সে চেষ্টা করিত, শাক তুলিয়, তরকারী কুটিয়া দিয়া। আগে আগে আসিয়া চালের বাত ধরিয়া দাড়াইরা থাকিত, ইদানীং দাওয়ার কোণে ওইখানটায় বসিত। তার মুখের ভাব দিন দিন যেন আরও মুত্র হইয়া উঠিতেছিল । পলাশপুরে তো কত লোক আছে, হাটতলায় তো কত লোক যাতায়াত করে, এই দরিদ্র ডাক্তারের নিঃসঙ্গ জীবনের প্রতি কেহই তো অমন দরদ দেখায় নাই—তাই বলি পুরুষমানুষের মেয়েমানুষের মত বন্ধু কোথায় ? গত ফান্ধন মাসে উপরি উপরি কয়েকদিন সে আসিল না । মনটা উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল । এমন তো কখনও হয় না। দু-তিন দিন পরে কানে গেল বিধু গোয়ালিনীর মেয়ের টাইফয়েড হইয়াছে। কেহ ডাকিতে না আসিলেও দেখিতে গেলাম। দেখিয়া শুনিয়া বুঝিলাম, এ বয়সে টাইফয়েড, শিবের অসাধ্য রোগ। প্রাণপণে চিকিৎসা করিতে লাগিলাম—উহার সাতদিন পরে আমার উপরে আস্থা হারাইয়া ডাকিল ইন্দু ডাক্তারকে। আমাকে রোগশয্যার পাশে দেখিয়া প্রমোর মুখ আননে উজ্জল হইয়া উঠিয়াছিল প্রথম দিন। শুনিলাম ইন্দু ডাক্তার যেদিন দেখিতে আসিয়াছিল, সেদিন সে ইন্দু ডাক্তারের ঔষধ খাইতে চায় নাই। মরণের ছয় সাত দিন পূৰ্ব্ব হইতে সে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল । আজ কয়েক মাস হইল আমি আবার যে এক, সেই একা। কে আর আমার জন্ত শাক, ডুমুর, বেটকোলের ডগা তুলিয়া দিবে, এখন আবার সেই আম-ভাতে ভাত । বর্ষ নামিয়া গিয়াছে। রাস্তাঘাটে বেজায় কাদা, মশার উৎপাত বাড়িয়াছে। হাটতলার চারিপাশের বাগানের বড় বড় গাছের মাথায় সারাদিন ধরিয়া মেঘ জমিতেছে, ঝুপ কুপ বৃষ্টি পড়িয়া আকাশ একটুখানি ফরসা হইতেছে...আবার মেঘ উড়িয়া আসিতেছে, আবার বৃষ্টি । জলে ভিজিয়া গাছের গুড়িগুলির রং আবলুসের মত কালো দেখাইতেছে। চুপ করিয়া বসিয়া থাকি। মনে হয় কারাগারে আবদ্ধ হইয়া আছি। যখন নিতান্ত অসহ