পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৭২ বিভূতি-রচনাবলী আমার বিবাহের কথা বলিবার সুযোগ খুজিতেছিলাম, ভাবিলাম এইবার মোলায়েম করিয়া বলিয়া ফেলি বন্ধুপত্নীর নিকট । কিন্তু বন্ধুপত্নীও যে আর একটি কথা বলিবার স্বযোগ খুজিতেছিলেন, তাহা বুঝি নাই। বলিলেন–জানেন একটা কথা বলি। সেই যে আমাদের দেশের মেয়েটির কথা বলেছিলুম, মনে আছে ? সেই মণিমালা ? —ই্য, খুব আছে। মনে মনে একটু শঙ্কিত হইয়া উঠিলাম । –এই গত পৌষ মাসে শিবতলায় আমার তার সঙ্গে দেখা। দু-বছর দেখা হয় নি, কথা আর ফুরুতে চায় না। তার বিয়ে হয় নি এখনও । কেন হয়নি সে কথা আমি জিজ্ঞেস করি নি, তবে ভাবে বোঝা তো যাচ্ছে ও রকম গরীব-ঘরের মেয়ের কেন বিয়ে হতে দেরি হয় । আমি কথা বলিৰার জন্তই বলিলাম—ই্যা, তা বইকি । —তারপর শুমুন, কথায় কথায় কলকাতার কথা উঠল । সে কখনও কলকাতা দেখে নি । আমি হেসে বললুম–আচ্ছ, তোমায় শীগগির কলকাতা দেখাচ্ছি। এ-কথায় মেয়েটি হাসলে। ভারী বুদ্ধিমতী মেয়ে, ও বুঝতে পেয়েছে আমি কি বলছি। একটু পরে নিজেই বললে— আপনাদের বাড়িতে সেই যে ভদ্রলোক আসতেন, তিনি আর আসেন না ? আমি বললাম— অনেক দিন আসেন নি, তার পর হেসে বললাম—তবে একটা কথা জানি, তিনি এখনও বিয়ে করেন নি, তাহলে একখানা অন্তত নেমস্তল্পের চিঠি তো আমরা পেতাম নিশ্চয়ই। মেয়েটি হেসে চুপ করে রইল। আমার বেশ মনে হয় সে এখনও মনে মনে ভাবে আপনি তাকে বিয়ে করবেন। তার উপর আবার শুকুন, হয়তো আমার উচিত হয় নি এত কথা বলা—আসবার সময় আবার তাকে বললাম—তাহলে কিন্তু এবার কলকাতা দেখার ব্যবস্থা করছি । মেয়েটির লজ্জা হ’ল কিন্তু মুখ দেখে মনে হ’ল ভারী খুশী হয়ে উঠেছে মনে মনে । মুখে কেবল একটা কথা বলেছিল উঠে আসবার সময়। যেন তাচ্ছিল্যের মুরে হঠাৎ বললে—আমার আর অমত কি, তবে তুমি ভাই দিদিমাকে একবার ব'লো। সত্যই সে আপনার আশায় আশায় রয়েছে, এ আমি জোর ক’রে বলতে পারি। যা বলেছে, মেয়েমানুষ তার চেয়ে আর কি বেশী বলবে ? এ দোষ আমারই, সেজন্যে ওঁর সামনে বললাম না। উনি শুনলে রাগ করবেন। আমার অনুরোধ, ঠাকুরপো, দয়া করে গরীব-ঘরের মেয়েটাকে নিয়ে তাদের দায় উদ্ধার করুন। আপনি তাকে নিয়ে জীবনে সুখী হবেন, একথা বলতে পারি। অমন মুত্র, সরলা, শাস্ত মেয়ে পাবেন না— হ'লই বা গরীব ? আমার বন্ধু পান কিনিয়া ফিরিয়া আসাতে কথাটা চাপা পড়িল । অতঃপর আর আমার বিবাহের কথা ইহাদের নিকট বলিতে পারিলাম না। হয়তো একটু গৰ্ব্ব করিয়াই বলিতাম আমার স্ত্রী সত্যই সুন্দরী, এমন কি ইহাও ভাবিতেছিলাম এক দিন উভয়কে বাসায় নিমন্ত্ৰণ করিয়া লইয়া গিয়া স্ত্রীর গান শুনাইয়া দিব—কিন্তু বন্ধুপত্নীর সহিত কথাবার্ভার পরে আমার মুখ যেন কে চাপিয়া ধরিল। কেন যে এমন সব ধরণের ব্যাপার ঘটে ! কোথায় কাহাকে কে গোসগল্পের ছলে কি বলিল, তাহাই শুনিয়া একটি সরল পল্লীবালিকা মনে কি জানি সব স্বপ্নজাল বুনিতেছে এখনও, অথচ যাহাকে বিরিয়া এ স্বপ্ন রচনা—এ বিষয়ে সে কিছুই জানে না, সে দিব্য আরামে চাল দিয়া কলিকাতায় বেড়াইতেছে, বিয়ে-খাওয়া করিয়া নববধূকে লইয়া মশগুল হইয়া মহামুখে দিন কাটাইতেছে।