পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ হাসের ডিম, তিল, আকের গুড়, আরও অনেক জিনিস নোঁকে বোঝাই হয়ে আসতো । ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে তার প্রতিবার এই সময় পাঠাবলি দিয়ে মনসা পূজো করতেন ও গ্রামের ব্রাহ্মণ খাওয়াতেন। এদের সত্যনারায়ণ পূজো ঘরের স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করার জন্তে, লক্ষ্মীপুজো ধনধান্ত বৃদ্ধির জন্তে, গৃহদেবতার পূজে, গোপীনাথ জীউর পূজো—সবারই মূলে—হে ঠাকুর, ধনেপুত্রে যেন লক্ষ্মীলাভ হয় অর্থাৎ তা হ'লে তোমাকেও খুশী রাখবো। বাবার মুখে শুনেচি, এ সমস্ত বাড়িঘর আমার ঠাকুরদাদা গোবিন্দলাল মুখুয্যের তৈরি। ঠাকুরদাদা যখন মারা যান, বাবার তখন বয়স বেশী নয়। তিনি মামার বাড়িতে মানুষ হন এবং তারপর চাকরি নিয়ে বিদেশে বার হয়ে যান। জ্যাঠামশাইয়ের বাবা নন্দলাল মুখুয্যে নায়েবী কাজে বিস্তর পয়সা রোজগার করেছিলেন এবং আবাদ অঞ্চলে একশো বিঘে ধানের জমি কিনে রেখে যান। আবাদ-অঞ্চল মানে কি, আমি এতদিনেও জানতাম না, এই সেদিন জ্যাঠামশাইদের আড়তের মুহুরী যন্থ বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস ক'রে জেনেছি। জ্যাঠামশাই পাটের ব্যবসা করে খুব উন্নতি করেছে। এদের বর্তমান উন্নতির মূলেই এদের পাটের ও ধানের কারবার। জ্যাঠামশাইরা তিন ভাই—সবাই এই আড়তের কাজেই লেগে আছেন দেখতে পাই । এর বাবার খুড়তুত ভাই, বাবাই ঠাকুরদাদার একমাত্র ছেলে ছিলেন। বাবা কোনো কালেই এ-গায়ে বাস করেননি, জমিজমা যা ছিল তাও এখন আর নেই, বাবা বেঁচে থাকতে জ্যাঠামশায়কে বলতে শুনেছিলাম যে, সব নাকি রোডসেস নীলামে বিক্রি হয়ে গেছে। সে-সব কি ব্যাপার যত বুঝি আর না বুঝি, এটুকু আজকাল বুঝেছি যে, এখানে আমাদের দাবি কিছু নেই এবং জ্যাঠামশাইদের দয়ায় তাদের সংসারে মাথা গুজে আমরা আছি । জ্যাঠাইমাকে আমার নতুন নতুন ভারি ভাল লাগতে, কিন্তু এতদিন আমরা এ বাড়িতে এসেচি, একদিনের জন্তও আমাদের সঙ্গে তিনি ভাল ব্যবহার করেননি—আমাকে ও দাদাকে তো নখে ফেলে কাটেন এমনি অবস্থা। অনবরত জ্যাঠাইমার কাছ থেকে গালমন্দ অপমান খেয়ে খেয়ে আমারও মন বিরূপ হয়ে উঠেচে । আজকাল আমি তো জ্যাঠাইমাকে এড়িয়ে চলি, সীতাও তাই, দাদা ভালমন কিছু তেমন বোঝে না, ও নবায়ের দিন বাটি হাতে জ্যাঠাইমায়ের কাছে নবান্ন চাইতে গিয়ে বকুনি থেয়ে ফিরে আসবে—পুকুরের ঘাটে নাকি জ্যাঠাইমা নেয়ে উঠে আসছিলেন, ও সে-সময় ঝাপিয়ে জলে পড়ার দরুন জল ছিটিয়ে তার গায়ে লাগে, সেজন্তে মার খাবে—বাসি কাপড়ে জ্যাঠাইমার ঘরে ঢুকে এই সেদিনও মার খেতে খেতে বেঁচে গিয়েচে । কেন বাপু যাওয়া ? কিন্তু না গেলেই যে বিপদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা নয়, এক সংসারে থাকতে গেলে ছোয়াছুয়ি ঠেকাঠেকি না হয়ে তো পারে না, অথচ হ’লেই আর রক্ষে নেই। জ্যাঠাইমাদের রোয়াকে বসে আমি আর ভুবন খেলছি—এমন সময় জ্যাঠাইমা ওপরের দালান থেকে বিষ্ট, বাদল, উষা, কাতু—ওদের ডাক দিলেন। ডাকলেন কেন, আমি তা জানি, খাবার খাওয়ার জন্তে—আমি আর ভুবন যে সেখানে আছি, তা দেখেও দেখলেন না। আমি ভুবনকে বসতে বলে মায়ের কাছ থেকে বড় এক বাট মুড়ি নিয়ে এসে দু'জনে খেতে লাগলাম। কাতু ফিরে এলে বললাম—ভাই, এক ঘটি জল নিয়ে আয় না খাবো! খাবার খাওয়া সেরে আমরা আবার খেলা করচি, এমন সময়ে জ্যাঠাইমা সেখানে এলেন কাপড় তুলতে। রোরাকের ধারে আমাদের মুড়ির বাটিটার দিকে চেয়ে বললেন—এ বাটতে হাত ধুয়েচে কে ?