পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২০8 বিভূতি-রচনাবলী পনর-কুড়ি দিনের উদ্বেগে, কষ্ট্রে, উপবাসে শীর্ণদেহা-তার স্বায়ুতন্ত্রীও ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছে— তার মনে বল নাই শরীরে সামর্থ্য নাই.. কিন্তু উদার নীল আকাশে প্রভাতের স্বৰ্য্য উঠিয়াছে, যেমন উঠিত তাহার জন্মভূমিতে, পাখীরা কলধ্বনি করিতেছে, যেমন করিত তাহদের নদীর ধারের মাঠের অনেক দিনের সেই পক্ষী বন্ধুটি, বাঁশতলায় প্রথম বর্ষার জলে পুষ্ট হইয়া পিপুল লতা বাড়িয়া উঠিয়াছে, অনন্তমূলের চারা বাহির হইয়াছে, গ্রামে গ্রামে 'বেী-কথা-কও পাখীর সেই সুন্দর আবাল্য পরিচিত ডাক--- সম্মুখে অনেক দূরে কোথায় তাহাদের গ্রামখানি, ছোট নদীটী—মুগন্ধি অনন্তমূলের কচি পাতার কি চমৎকার আস্বাদ ।...এই তো জীবনকে সে আবার খুজিয়া পাইয়াছে’কত কালের পরে মুক্তি আসিয়াছে ‘‘এখন মরিলেও তার দুঃখ নাই—শিয়াল শকুনে তার জীর্ণ দেহটা খাইয়া ফেলিলেও দুঃখ নাই—তবে ছোট্ট খুকীটাকে একবার দেখিয়া সে মরিবে— আবার সে রাস্তা খুজিয়া বাহির করিল—এই মাঠের ধারেই একদিন তাহার দলের সঙ্গীদের সঙ্গে, এই গাছতলায় রাত্রে শুইয়াছিল বটে। যাহারা তাহাদের তাড়াইয়া আনিতেছিল, এই গাছতলাভেই তাহারা রাত্রে রাধিয়া খাইয়াছিল। আবার পথ-চলিয়াছে; চলিয়াছে পথের শেষ নাই—প্রভাত দুপুরে পরিণত হইল—দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইল। ক্ষুধা পাইয়াছিল, এক জায়গায় পথের ধারে ছোট বিল—বিলের ধারে ভারী চমৎকার সবুজ ঘাস ! বুধীর লোভ হইল—সে রাস্ত হইতে নামিয়া বিলের ধারে গেল— নরম কচি ঘাসে মুখ ডুবাইয়। সে গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল । বিলের ধারে আরও কয়েকটি গরু চরিতেছিল । একজন বলিল—এ বুড়ী কোথেকে এসে জুটলো হে? একে তো চিনিনে ! আর একজন বলিল—চেহারা দেখ না—যেন কসাইখানার ফেরত ! হাড়-পাজরা গুনে নেওয়া যাচ্চে ! মরি মরি, কি যে রূপ! বলি, ওগো, তোমার বাড়ি কোথায় ? ইহার বুধীর সন্তানের বয়সী, ইহাদের ফাজলামি তাহার ভাল লাগিল না। সে কথার কোন উত্তর না দিয়া গম্ভীর মুখে আপন মনে ঘাস খাইতে লাগিল। নিজের মান নিজের কাছে । তাহাতেও নিস্তার নাই । বেয়াদব ছোকরা আগাইয়া আসিয়া বলিল—বলি, কথা বলচো না কেন বুড়ী ? কসাইখান থেকে পালিয়ে আসচো নাকি ? এমন চেহারা কেন ? হঠাৎ বুধীর ভয় হইল । কসাইখানা কি জিনিস ? পলাইয়া তো আসিয়াছেই বটে-আর সে সেখানে দাড়ানো নিরাপদ মনে করিল না। লোভনীয় কচি ঘাসগুলি ফেলিয়া ছুট দিয়া রাস্তার ওপর আসিয়া উঠিল। পিছন হইতে একজন বলিয়া উঠিল--অারে বাবা, কোথাকার অসভ্য জানোয়ার । ভদ্রলোকের কথার উত্তর দিতে হয় তাও জানে না ? চলিতে চলিতে একদিন বুধী কি করিয়া বুঝিতে পারিল সে ভুল পথে চলিতেছে। এ রাস্ত বাহিয়া এতদূর সে আসে নাই। মাঠের মধ্যে একটা কাচা রাস্তা কোথা দিয়া যেন নামিয়া গিয়াছিল—সেই মেটে রাস্ত দিয়া আসিয়া সেবার তাহাদের দল উঠিয়াছিল বড় রাস্তাটায়। বুধী ঠিক ঠাহর করিতে পারে নাই, কোথায় সেই মেটে রাস্তা বড় রাস্ত হইতে নামিয়া গিয়াছে। ঠিক তাহাই ঘটিল। সম্মুখে একটা নদী পড়িল । এ নদী সে দেখে নাই। সে পথ ভুল করিয়াছে । সে বড় রাস্ত হইতে নামিয়া পড়িল—মাঠের মাঝখান বাহিয়া কত সরু সরু রাস্তাই চলিয়াছে –এর একটাও পূৰ্ব্ব পরিচিত নয়। কতকগুলি গন্ধ ও কতকগুলি বিশেষ ছবি বুধীর মনে আছে