পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ }& নিস্তন্ধ স্থানে এক গিয়ে বসতাম। § চুপ করে বসে থাকতে থাকতে দেখেচি অনেক দূরে পাহাড়ের ও বনানীর মাথার ওপরে নীলাকাশ বেয়ে যেন আর একটা পথ—আর একটা পাহাড়শ্রেণী—সব যেন মুছ হলুদ রঙের আলো দিয়ে তৈরি—সে অন্ত দেশ, সেখানেও এমনি গাছপালা, এমনি ফুল ফুটে আছে, হলুদ আলোর বিশাল জ্যোতিৰ্ম্ময় পথটা এই পৃথিবীর পর্বতশ্রেণীর ওপর দিয়ে শূন্ত ভেদ ক’রে মেঘরাজ্যের ওদিকে কোথায় চলে গিয়েছে—দূরে আর একটা অজান লোকালয়ের বাড়িঘর, তাদের লোকজনও দেখেচি, তারা আমাদের মত মানুষ না—তাদের মুখ ভাল দেখতে পেতাম নী—কিন্তু তারাও আমাদের মত ব্যস্ত, হলুদ রঙের পথটা তাদের যাতায়াতের পথ। ভাল করে চেয়ে চেয়ে দেখেছি সে-সব মেঘ নয়, মেঘের ওপর পাহাড়ী রঙের খেলার ধাধা নয়—সে-সব সত্যি, আমাদের এই পৃথিবীর মতই তাদের বাড়িঘর, তাদের অধিবাসী, তাদের বনপৰ্ব্বত, সত্যি —আমার চোখের ভুল যে নয় এ আমি মনে মনে বুঝতাম, কিন্তু কাউকে বলতে সাহস হ’ত নী—মাকে না, এমন কি সীতাকেও না—পাছে তারা হেসে উঠে সব উড়িয়ে দেয় । এ রকম একবার নয়, কতবার দেখেছি। আগে আগে আমার মনে হ’ত আমি যেমন দেখি, সবাই বোধ হয় ওরকম দেখে। কিন্তু সেবার আমার ভুল ভেঙে যায়। আমি একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—আচ্ছ মা, পাহাড়ের ওদিকে আকাশের গায়ে ও-সব কি দেখা যায় ? -- মা বললেন—কোথায় রে ? —ওই কাট রোডের ধারে বেড়াতে গিয়ে এক জায়গায় বসেছিলাম, তাই দেখলাম আকাশের গায়ে একটা নদী—আমাদের মত ছোট নদী হয়—সে খুব বড়, কত গাছপালা— দেখনি মা ? —দূর পাগলা—ও মেঘ, বিকেলে ওরকম দেখায়। —না মা, মেঘ নয়, মেঘ আমি চিনিনে ? ও আর একটা দেশের মত, তাদের লোকজন পষ্ট দেখেচি যে—তুমি দেখনি কখনও ? —আমার ওসব দেখবার সময় নেই, ঘরকন্না তাই ঠেলে উঠতে পারিনে, নিতুটার আবার আজ পড়ে পা ভেঙে গিয়েচে—আমার মরবার অবসর নেই—ও-সব তুমি দেখগে বাবা । বুঝলাম মা আমার কথা অবিশ্বাস করলেন । সীতাকেও একবার বলেছিলাম—সে কথাটা বুঝতেই পারলে না। দাদাকে কখনো কিছু বলিনি। আমার মনে অনেকদিন ধ’রে এটা একটা গোপন রহস্তের মত ছিল—যেন আমার একটা কি কঠিন রোগ হয়েছে—সেটা যাদের কাছে বলছি, কেউ বুঝতে পারছে না, ধরতে পারছে না, সবাই হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। এখন আমার সয়ে গিয়েছে। বুঝতে পেরেছি—ও সবাই দেখে না—যার দেখে, চুপ করে থাকাই তাদের পক্ষে সব চেয়ে ভালো । আমাদের বাসা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সব সময়ই চোখে পড়ে। জ্ঞান হয়ে পর্য্যস্ত দেখে আসচি বহুদূর দিক্‌চক্রবালের এ-প্রান্ত থেকে ও প্রাস্ত পৰ্য্যন্ত তুষারমেলি গিরিচূড়ার সারি—বাগানের চারিধারের পাহাড়শ্রেণীর যেন একটুখানি ওপরে বলে মনে হ’ত—তখনো পৰ্য্যস্ত বুঝিনি যে ও-গুলো কত উচু। কাঞ্চনজঙ্ঘা নামটা অনেকদিন পর্যন্ত জানতাম না, আমাদের চাকর থাপাকে জিজ্ঞেস করলে বলত, ও সিকিমের পাহাড় । সেবার বাবা আমাদের সবাইকে ( সীতা বাদে) দাৰ্জিলিং নিয়ে গিয়েছিলেন বেড়াতে—বাবার পরিচিত এক হিন্দুস্থানী চায়ের এজেন্ট ওখানে থাকে, তার বাসায় গিয়ে দু-দিন আমরা মহা আদর-যত্বে কাটিয়েছিলাম—তখন বাবার