পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/২৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রূপহলুদ ২৬৭ সেদিন দুপুরে এক ঘটনা ঘটলে । আমি ভাত নামিয়ে হাড়ি রাখতে যাচ্ছি, এমন সময় দোতলার বারান্দাতে অনেক লোক যেন একসঙ্গে হেসে উঠলো। সে কি ভীষণ অট্টহাসি ! আমার গা যেন দোল দিয়ে উঠলে সে হাসি শুনে । খিলখিল কয়ে হাসি নয়—খলখল করে হাসি । আকাশ-বাতাস থমথমিয়ে উঠলো সে হাসির শব্দে । ভাত ফেলে রেখে দৌড়ে গেলাম। রোয়াকে গিয়ে ওপরের দিকে দেখি, কিছুই না। নিচের জানলা যেমন বন্ধ, ওপরের ঘরের সারবন্দি জানলা তেমনি বন্ধ। হাসির লহর তখন থেমে নিশ,প হয়ে গিয়েচে । ব্যাপার কি ? কোনো বদমাইশ লোকের দল ওপরে আডডা বেঁধেছে ? ওপরের সিড়ির মুখে গিয়ে দেখি দরজায় তেমনি কুলুপ ঝুলচে। আমার ভয় হয়নি। কেননা দিনমান, চারিদিকে সূর্য্যের আলো । এ সময়ে মনের মধ্যে কোন ভূতের সংস্কার থাকে না । এই হাসিই যদি আমি রাত্রে শুনতাম, তবে বোধ হয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম, চাবি দিয়ে দাত খুলতে হোত । 輸 রান্নাঘরে ফিরে এসে ভাতের কেন গেলে ঝিঙের তরকারি চাপিয়ে দিই। প্রচুর বিঙে জঙ্গলে ফলেচে, যত ইচ্ছে তুলে নিয়ে খাও । আমারই বাড়ি, আমারই বিঙে-লত । মালিক হওয়ার যে একটা মাদকতা আছে, তা কাল থেকে বুঝচি। আমার মতো গরীব বামুনের জীবনে এমন জিনিস এই প্রথম । কান পেতে রইলাম ওপরের ঘরের কোনো শব্দ আসে কিনা শুনতে। ছাঁচ পড়বার শব্দও পেলাম না। খেয়েদেয়ে নিজের মনে বিছানায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েচি—ঘুমের ঘোরে শুনচি, ঘরের মধ্যে অনেক লোক কথাবাৰ্ত্তা বলচে, হাসচে। ঘুমের মধ্যেও আমি ওদের কথাবাৰ্ত্তা যেন শুনচি, যেমন কোনো বিয়েবাড়িতে ঘর-ভৰ্ত্তি লোকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে লোকজনের গলার শব্দ ঘুমের মধ্যেও পাওয়া যায় ! হয়ত সবটাই আমার মনের ভুল ! মনের সেই যে ভাব হয়েছিল হাসি শুনে, তারই ফল ! এর পর ন’দিন আর কোনো কিছু ঘটেনি। মামুষের মনের অভ্যাস, অপ্রীতিকর জিনিসগুলো তাড়াতাড়ি দিব্যি ভুলে যেতে চায়, পারেও ভুলে যেতে । আমি নিজের মনকে বোঝালুম, ওসব কিছু না, কি শুনতে কি শুনেচি, বে দেখা চোখের ভুল, হাসি শোনাও কানের ভুল! সব ভুল । এ ন'দিনে আমার শরীর বেশ সেরে উঠলো। খাই-দাই, আর শুধু ঘুমুই । কাজ-কৰ্ম্ম কিছু নেই—কেমন একরকমের কুড়েমি পেয়ে বসেছে আমাকে । আমি সাধারণতঃ খুব খাটিয়ে লোক, শুয়ে বসে থাকতে ভালোবাসিনে—কিন্তু অনেকদিন ধরে অতিরিক্ত খাটুনির ফলে কেমন একরকমের অবসাদ এসে গিয়েচে, শুধুই আরাম করতে ইচ্ছা হয়। ন'দিনের দিন বিকেলে মনে হোল রান্নাঘরের পেছনে সেই ঝিঙের জঙ্গলটা কেটে একটু পরিষ্কার করি, ঝিঙের লতাগুলো বাচিয়ে অবশু । ওখানে ঝালের চারা পুতবে, আর একটা চালকুমড়োর এটে লতা হয়েচে ওই জঙ্গলের মধ্যে, সেটা বাশের কঞ্চি দিয়ে রান্নাঘরের ছাদে উঠিয়ে দেবো। এ বাড়িতে কাজ করে সুখ আছে ; কারণ দা, কোদাল, কাস্তে, নিড়েন, শাবল, কুড়ল, সব মজুত আছে—ঘরের কোণে একটা হাত-করাত ইস্তক। অল্পক্ষণ মাত্র কাজ করেছি—আধ ঘণ্টাও হবে না।