পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯০ বিভূতি-রচনাবলী তার কান্নার কোন ভাষা খুজে পেলাম না। কেবল একটা করুণ সুর সারা ঘরময় ঘুরে ঘুরে মরতে লাগল। তার পর সেই থাটের উপর গিয়ে সেই বিলাপ-ধ্বনি আর নড়ল না। তার কান্নায় যেন খাটটা ভিজে গেল । সেই অবোধ্য ভাষার সকরুণ বিলাপ-ধ্বনি চিত্তে এমন এক অজ্ঞাত বেদনার সঞ্চার করল, যার ফলে আমাদের সমস্ত শক্তি যেন ক্রমে ক্রমে লোপ পেতে লাগল। মনে হোল, কে যেন ক্লোরোফ দিয়ে আমাদের অজ্ঞান করে দিচ্ছে! আমরা যেন ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ছি ! সতীশের সাহসটা ছিল কিছু বেশী, তাই সে খাটের উপর টর্চ ফেলে গর্জে উঠল—কে, কে ওখানে ? কিছুই দেখা গেল না, কেউ সাড়া দিল না। সহসা সেই খাটখানা ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিল । মনে হোল অগণিত নরকঙ্কাল যেন তার চারিদিকে নৃত্য করচে। তাদের হাড়ের খটখট শব্দে কানের পর্দা ছিড়ে যাবার উপক্রম হোল। আমার বুকের ভেতরটা টনটন করতে লাগল কিসের যেন বেদনায়। বোধ হোল, হয়তো বুকখানা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে! একটু একটু করে আমার জ্ঞান হারিয়ে গেল । তারপর কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বোধ হোল, আমি যেন অনেক দূরে এক চীনাবাড়ী গিয়ে হাজির হয়েছি। একটি ছোট ঘয়ে তখন সেই গভীর রাতে টিম-টিম করে একটি দীপ জলছিল। ঘরের মেঝের উপর একটি লোক মুমু অবস্থায় পড়ে রয়েচে । একটা ছেড়া মাদুরের ওপর তার সেই রোগ-পাণ্ডুর মুখখান দেখে আমার বড় দয়া হোল। রোগে ভুগে ভুগে বেচারা কঙ্কালসার হয়ে গেছে। তার পাশে বসেছিল—তার স্ত্রী হবে বলেই বোধ হোল—চেহারা কিন্তু তার স্বামীর চারগুণ। একটা মস্ত টুলের ওপর বসে সে ঢুলছিল। তার পাশেই আমাদের এই থাটটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাত সমুদ্র তের নদী পার করে এটাকে কে এখানে নিয়ে এল ? হঠাৎ স্ত্রীলোকটি বিকট এক ইা করে হাই তুলল, তারপর দুটাে সশক তুড়ি দিয়ে একবার ঘরের চারিদিকে চেয়ে দেথল। দেখলাম—তার স্বামী ইতিমধ্যে উঠে সেই থাটের দিকে এগিয়ে গেছে চুপি চুপি । চকিতে ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত তার স্ত্রী তাকে জোর করে থাট থেকে নামিয়ে বিছানায় ফেলে দিলে। সে ভীষণ ভাবে গর্জন করতে লাগল, আর তার স্বামী ব্যাকুলভাবে অনুনয় করতে লাগল, ঐ খাটের পানে অঙ্গুলী-সঙ্কেত করে –বোধ হল, সে চায় থাটে উঠতে ; কিন্তু তার স্ত্রী তাকে কিছুতেই উঠতে দেবে না। উত্তেজনায় কাশতে কাশতে তার মুখ দিয়ে একঝলক রক্ত বেরিয়ে গেল। আমি শিউরে উঠলাম। তারপর লোকটার মাথাটা বিছানায় লুটিয়ে পড়ল, আর সে উঠল না। তার স্ত্রী তার পাশে বসে বিনিয়ে বিনিয়ে কঁদিতে লাগল । যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম—ভোরের আলোয় চারদিক ভরে গেছে । দেখলাম—সতীশের মা আমার চোখে-মুখে জলের ছিটে দিচ্ছেন। তিনি আমার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে বল্লেন—থগেন, বাবা খগেন ! আমি বল্লাম—আমি কোথায় ? —নীচের ঘরে । —সতীশ কোথায় ? —সতীশের এখনও জ্ঞান হয়নি ।