পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ । *〉 আমাদের থাকবার ঘর দেখে তো আমরা অবাকৃ। এত বড় বাড়িতে এ ঘরটা ছাড়া তো আরো কত ঘর রয়েছে! নীচের একটা ঘর, ঘরের ছাদে মাটির নীচের কড়িকাঠ ঝুলে পড়েছে বলে খুঁটির ঠেকনো। কেন ওপরে দোতলায় তো কত ঘর, এত বড় বাড়ি তো ! অন্ত ঘরে জায়গা হবে না কেন ? এই খারাপ ঘরটাতে আমরা থাকবো কেন ? দেখলাম বাবা মা বিনা প্রতিবাদে সেই ঘরটাতেই আমাদের জিনিসপত্র তুললেন । দিন-চারেক পরে জ্যাঠাইমা একদিন আমায় জিজ্ঞেস করলেন—স্থ্যা রে, তোর মাকে নাকি সেখানে মেমে পড়াতো ? অামি বললাম, হ্যা, জ্যাঠাইমা । গৰ্ব্বের সুরে বললাম—আমাকে, দাদাকে, সীতাকেও পড়াতে । জ্যাঠাইমা বললেন—তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ছিল নাকি তোদের ? আমি বাহাদুরি করে বললাম—তারা এসে চ খেত আমাদের বাড়ি । আমাদের বিস্কুট দিত, কেক্‌ দিত খেতে তাদের ওখানে গেলে—চা খাওয়াতো— জ্যাঠাইমা টান-টানা মুরে বললেন—মাগো মা ! কি হবে, আমাদের ঘরে-দোরে তো যখন-তখন উঠছে, হিন্দুর ঘরের জাতজন্ম আর রইল না । o আমি তখন বুঝতে পারিনি কেন জ্যাঠাইম। এ রকম বলছেন । কিন্তু শুধু এ কথা নয়— আমি ছেলেমানুষ, অনেক কথাই তখন জানতাম না । জানতাম না যে এই বাড়িতে আমার বাবার অংশটুকু অনেক দিন বিক্রী হয়ে গিয়েছে, এখন যে এদো ঘরে আমরা আছি, সে-ঘরে কোনো স্তায্য অধিকার আমাদের নেই—জ্ঞাতি জ্যাঠামশাইরা অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞার সঙ্গে থাকতে দিয়েছেন মাত্র। জানতাম না যে, আমার বাবা বর্তমানে অর্থহীন, অসুস্থ ও চাকুরিহীন, সরিকের বাড়িতে আশ্রয়প্রার্থী। আরো জানতাম না যে, বাবা বিদেশে থাকেন, ইংরেজী জানেন ও ভাল চাকুরি করেন বলে এদের চিরদিন ছিল হিংসে—আজ এ অবস্থায় হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে তারা যে এতদিনের সঞ্চিত গায়ের ঝাল মেটাতে ব্যগ্র হয়ে উঠবেন সেটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও ছায়সঙ্গত। চাকুরির অবস্থায় মাকে নিয়ে বাবা কয়েকবার এখানে এসে চাল দেখিয়ে গিয়েছিলেন, এরা সে-কথা ভোলেনি। ছেলেমানুষ বলেই এত কথা তখন বুঝতাম না । 4 আমরা কখনো দোতলা বাড়ি দেখিনি—গায়ে ঘুরে ঘুরে দোতলা কোঠ বাড়ি দেখতে আমাদের ভারি ভালো লাগতে, বিশেষ ক'রে সীতার। সীতা আজ এসে হয়তো বলে—কাল যেও আমার সঙ্গে দাদা, ও-পাড়ার বাড়য্যে-বাড়ি কত বড় দেখে এসো-দোতলার ওপরে আবার একটা ছোট ঘর, সত্যি দাদা ! আমাদের গ্রামে খুব লোকের বাস—এক এক পাড়াতেই ষাট-সত্তর ঘর ব্রাহ্মণ । এত ঘন বসতি কখনো দেখিনি—কেমন নতুনতর মনে হয়, কিন্তু ভাল লাগে না। এতে যেন মন হাত পা ছড়াবার জায়গা পায় না। সদাই কেমন অস্বস্তি বোধ হয়—রাস্তায় বেজায় ধুলো, পুরনো নোনাধরা ইটের বাড়িই অধিকাংশ, বিশেষ কোনো শ্ৰীছাদ নেই—পথের ধারে মাঝে মাঝে গাছপাল, সে-সব গাছপালা আমি চিনি নে, নামও জানি নে, কেবল চিনি কচুগাছ ও লালবিছুটি। এদের হিমালয়ে দেখেছি বলে নয়, কচুর ভাটার তরকারি এখানে এসে খেয়েছি বলে। আর আমার খুড়তুতে ভাই বিণ্ড একদিন সীতাকে বিছুটির পাতা দেখিয়ে বলেছিল—এর পাত তুলে গারে ঘষতে পারিস "বেচারী সীতা জানত না কিছু, সে বাহাম্বুরি দেখিয়ে একমুঠো পাতা তুলে বা হাতে আচ্ছা করে ঘষেছিল—তারপর আর যার কোথা!