পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

లిపి 8 বিভূতি-রচনাবলী কার আকাশের অপূৰ্ব্ব নীল রং দেখে সেখানটায় গামছা পেতে ঘাসের ওপর কতক্ষণ শুয়ে রইলুম। সে যে কি আনন্দ, তা হয়তো আমি নিজেই কিছুকাল পরে অবিশ্বাস করব, কারণ ওসব অনুভূতি মানুষের চিরকাল বজায় তো থাকে না, পরে শুধু স্মৃতিটা থাকে মাত্র। মাথার ওপরকার ঐ ময়ুরকষ্টি রংয়ের আকাশ, ঘাসের নীচে এই বিচরণশীল পোকামাকড়, ছোট ছোট ঘাসের ফুল, ঐ উড়ন্ত চিল, বটের ডালে লুকানো ঐ বেী-কথা-ক' পাখীর ডাক, কত বিচিত্র বনলত, বনফুল—ঐ সুর্য্য থেকে পাচ্চে এদের জীবন, রং ও আলো। কিন্তু এই সবের পিছনে, সুৰ্য্যেরও পিছনে, এই ভূতপাত্রী ধরিত্রীর সব রূপ-রস-গন্ধের পিছনে যে বিরাট অতিমানস শক্তির লীলা—তার কথা কেবলই এমনি দুপুরে নীল আকাশের দিকে চেয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে। ভেবে কিছু ঠিক করতে হবে তার কোন মানে নেই, এষ্ট ভাবনাতেই আনন্দ । তখন যেন মনে হয় এই বিশ্বের সঙ্গে আমি এক তারে গাথা—অদৃশু যে লতায় এই সব ফুল নিয়ে মালা গাথা হয়েচে, আমি তাদের দল থেকে বাদ পড়িনি, তাদেরই একজন—বিশ্বের সঙ্গে একটা যোগ স্থাপিত হয় মনে মনে । মনকে এভাবে তৈরী করে নেওয়ায় সার্থকতা আছে, কারণ মনই সব, মন যে ভাবে পৃথিবীকে দেখায়, জীবনকে দেখায়—মানুষে সেভাবেই দেখে। মন দুঃখ দেয়, মুখ দেয়—মনকে তৈরী করে যে না নিতে পেরেচে, তার দুঃখ অসীম । ঐ লতাবিতানের মধ্যে আজ সকালে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলুম—ভারী নিভৃত, ছায়াঘন স্থানটি। প্রকৃতি অনেক যত্বে একে যেন নিজের হাতে গড়েচে । কাঠবিড়ালী খেলা করচে, কত কি পাখী ডাকচে, পত্রান্তরাল থেকে একটু একটু রোদ এসে পড়েচে, ঠাণ্ড মাটিতে বড় চমৎকার ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে, কেয়োঝাঁক, ষাড়, ডুমুর, কুঁচকাটার লতার সমাবেশে এই ঝোপটা তৈরী—দুপুরের রোদে এই নিস্তব্ধ ঝোপের ছায়ানিবিড় আশ্রয়ে বসে বই পড়া কি লেখা বড় ভাল লাগে । এবেলা থেকে বর্ষা নেমেচে । ইছামতীর ওপরকার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা । আজ কলকাতায় রওনা হব ভেবেছিলুম–কিন্তু এরকম বাদলা দেখে পিছিয়ে গেলাম । আজ সারাদিন মনে একটা অপূৰ্ব্ব আনন্দ—কাল চলে যাব, গ্রীষ্মের ছুটি তো ফুরিয়ে গেল । যা দেখচি, সবাই বড় ভাল লাগচে । খুকু বার বার আসচে আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে, নানা ছুতোয় নানা ফাকে। সারা দিন আজ ভয়ানক বর্ষা—বৃষ্টির বিরাম নেই একদণ্ড । দুপুরের সময় যে বৃষ্টি নামল, তা ধরল বিকেল চারটের পরে। খান-ডোবা ভরে গিয়েচে । আমন ধানের মাঠে রোয়ার জল হয়েচে । বিলবিলে তো জলে টইটুম্বুর। মেঘমেদুর বিকেলে সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে জলের উপর পা ফেলে ছপ, ছপ, শব্দ করতে করতে গেলুম আইনদির বাড়ি—ওর সঙ্গে আমার জীবনের আনন্দময় দিনগুলোর যোগ আছে—যখনই খুব আনন্দ পেয়েচি, তখনই ওর বাড়িতে গিয়ে বসেচি এই ক' বছরের মধ্যে। আজও গেলাম। ওর বাড়ির দাওয়ায় বসে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের তলায় বাওড়ের ধারের ঘন সবুজ আউশের ক্ষেত ও প্রাচীন বটের সারির দিকে চোখ রেখে ওর সঙ্গে কত গল্প করলুম। বয়স হয়েছে ১৮ বছর, কিন্তু আইনদি কখনও শুধু হাতে বসে থাকে না। আমি যখনই গিয়েচি, তখনই দেখেচি ও কোন না কোনও একটা কাজ নিয়ে আছে—এখন সে একটা তলতা বাশের পাশ চাচছিল—বল্লে-মাছধরার ঘুনি বুনব। -