পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ミS সামনে হাত তিন-চার দূরে গোটাকতক ভাঙা হাড়িকুড়ি পড়ে আছে বটে, কিন্তু তার দরুন - গোট বনটা অপরিষ্কার কেন হবে তা বুঝতে পারলাম না আমরা তিনজনে কেউ। বিশেষ করে এটা আরো বুঝতে পারলাম না যে, পথ থেকে দূরে বনের মধ্যে বিকেলে কাপড় পরে যেতে দোষটা কিসের । চা-বাগানে থাকতে তো কত দূর দূর আমরা চলে যেতাম, কার্ট রোড, পচাঙের বাজার ; এখানেই বা কি বন, সেখানকার সেই সুনিবিড় বনানী পদচিহ্নহীন, নির্জন, আধ-অন্ধকার—কতদূরে, যেখানে যেখানে গিয়েছি কাপড় পরেই তো গিয়েছি— দাদা একটু ভীতু, সে ভয়ে নাইতে রাজী হ'ল। আমি বললাম-গীত, তুই আর আমি নাইবো না, কথখনে না। আমি যা বলি তাই শোনা সীতার স্বভাব—সে বললে, খুড়ীমা খুন করে কেলুলেও আমি নাইবো না দাদা। খুড়ীমা আমাদের সাধ্যমত নিৰ্য্যাতনের কোনো ক্রটি করলেন না। বাড়ি ঢুকতে দিলেন না, তার বড় ছেলে হারুদাকে বলে দিলেন আমাদের শাসন করতে, মাকে বললেন—তোমার ওই ডাকাত মেয়ে আর ডাকাত ছেলেকে আজ কি দশা করি তা টেরই পাবে—আমার সঙ্গে সমানে তক্‌কোতো করলেই আবার আমার কথার ওপর একগুঁয়েমি"। মা ওঁদের বাড়িতে এখন এসে রয়েছেন, ভয়ে কিছু বলতে পারলেন না। আমি সীতাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেলাম। ও-পাড়ায় পথের ধারে হ্যাম বাগচীদের পোড়ো বাড়ি, পেছনে তাদের বাগান, সেও পোড়ো। সারাক্ষণ আমরা সেখানে কাটালাম, সন্ধ্যার সময় দাদা গিয়ে ডেকে আনলে। বাড়িতে ঢুকতে যাব কাকা দোতলা থেকে বললেন—ওদের বাড়ি ঢুকতে দিও না বলছি—ওরা যেন খবরদার আমার বাড়ি না মাড়ায়, সাবধান —যেখানে হয় যাক, এত বড় আস্পদ সব— মা কিছু বলতে সাহস করলেন না, বৌমানুষ । বাবা বাড়ি ছিলেন না, চাকরির চেষ্টায় আজকাল তিনি বড় এখানে ওখানে ঘোরেন, কিছু পান না বোধ হয়—দু-একদিন পরে শুকনে মুখে ফিরে আসেন—সংসার একেবারে অচল। আমরা এক প্রহর রাত পৰ্য্যন্ত দরজার বাইরে দাড়িয়ে রইলাম। জ্যাঠাইমা, খুড়ীমা, জ্যাঠামশাই, দিদিরা কেউ একটা কথাও বললেন না। তারপর যখন ওদের দোতলায় খাওয়া-দাওয়া সারা হ’ল, আলো নিবল, মা চুপিচুপি আমাদের বাড়িতে ঢুকিয়ে নিলেন, বললেন–জিতু, খুড়ীমার কথা শুনলি নে কেন ? ছি— আমি বললাম—উনি যে কথা বলেন মা, তার কোনো মানে হয় না। আচ্ছ মা, তুমিষ্ট বলে আমরা সেখানে বনে বনে বেড়াতাম না ? আমরা কি নাইতুম ? আর বন কি আঁস্তাকুড় ? অন্যায় কথা ওঁর কথখনো শুনব না মা। এতে উনি মারুন আর খুনই করুন— মা অতি কষ্টে কান্না সামলাচ্চেন মনে হ’ল। বললেন—তুই যদি এরকম করিস তা হ’লে এ বাড়িতে ওরা আমাদের থাকতে দেবে না। আমাদের কি চেচিয়ে কথা বলবার জো আছে এখানে ? ছি বাবা জিতু, ওরা যা বলে শুনবি। ওরা লোক ভাল না—আগে জানলে ভিক্ষে ক’রে খেতাম তবুও এখানে আসতাম না। তোর বাবার যে একটা কিছু হ'লে হয়। বাবা কলকাতা থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরলেন। কাপড়-জামা এত ময়লা কখনো বাবার গারে দেখিনি। আমার কাছে ডেকে বললেন-শোন জিতু, এই পুটলিটা তোর মাকে দিয়ে আয়, আমি একবার ওপাড়া থেকে আসি। ভটচাষিদের নস্তির কারখানায় একটা লোকের নামে চিঠি দিয়েছে—ওদের দিয়ে আসি।