পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ δ44 গ্রাম ছাড়িয়ে এমন হল যে জল কোথাও পাওয়া যায় না—আমি একটি উপলাকীর্ণ শুষ্ক নদী খাতের পাশের জঙ্গলে একটা মোটা লতার উপর উঠে বসে রইলুম। একটু পরে গাইড এসে জলের সন্ধান দিলে। পাহাড়ী ঝর্ণ বেয়ে এক জায়গার জলাশয় স্বষ্টি করেচে। আমি সাতার দিয়ে সেই জলাশয়ে স্বান করলুম। মেয়ের রান্না চড়িয়ে দিলেন । আমি ও কনক ডান দিকের পাহাড়টাতে উঠলুম। কনক কিছুদূর গিয়ে আর উঠতে সাহস করলে না—আমি একটা মস্বর্ণ পাথর বেয়ে উঠে গেলুম। খুব ওপরে প্রায় পাহাড়ের শীর্ষদেশে উঠে দাড়িয়ে চারিদিকের পাহাড়গুলো চেয়ে দেখলুম। সব পাহাড়ের মাথাতেই বন । বনে আগুন লেগেছিল কিছুদিন আগে, এখনও এ পাহাড়ে একটা মোটা শেকড় ধোয়াচ্ছে। একটা শিবগাছের রেণু হাতে মেখে মুখে দিলাম, যেন পাউডার মুখে মাখচি এমনি সাদা হয়ে গেল। নামবার সময় মন্থণ পাথরখানা বেয়ে আর নামতে পারিনে, মাঝামাঝি এসে আটকে গেলাম—অবশেষে একটা শেকড় ধরে এসে নামলুম কনক যেখানে দাড়িয়ে আছে। আমার অবস্থা দেখে কনকের ভর হয়ে গিয়েছিল। আরও নেমে এসে তবে সেই জলাশয় ও সেই প্রস্তরাকীর্ণ উপত্যক, যেখানে মেয়ের রান্না করবেন। নেমে এসে দেখি রান্না হয়ে গিয়েচে । খাওয়া-দাওয়া সারতে ও বিশ্রাম করতে বেলা গেল। রওনা হবার সময়ে দেখি আমার পায়ের আঙ্গুলে পাহাড়ে ওঠবার সময়ে যে চোট লেগেছিল, তার দরুণ দস্তুরমত ব্যথা হয়েচে । সুতরাং গরুর গাড়িতে চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে এমন সুন্দর অপরাহ্ল নষ্ট করে ফেলতে হল বাধ্য হয়ে— কেবল পাহাড়ের ঘাট পার হয়ে ঘন জঙ্গলের পথে খানিকটা খালি পায়ে হেঁটে এসেছিলুম। পথে জ্যোৎস্না উঠল । এক জায়গায় বনের মধ্যে গাছতলায় আমরা শতরঞ্জি পেতে বসে চা করে খেলাম, গল্পসল্প করলাম। তারপর ক্রমেই পূর্ণিমার জ্যোৎস্না ফুটল। অপূৰ্ব্ব জ্যোৎস্বাময়ী রাত্রি। আর সেই বনভূমি, অজস্ৰ গোলগোলি ও পলাশ যেখানে ফুটে রয়েচে, যদিও জ্যোৎস্না রাত্রে এমন ফুল আদৌ দেখা যাচ্চে না । বন-কাটি নামে একটা খুব বড় সাওতালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে একটা বড় শাল-বনের পাশ কাটিয়ে রাত এগারোটার সময়ে গালুডি এলাম। আমরা যখন এলুম, তখন মেল ট্রেনের ঘণ্টা পড়ল স্টেশনে। পরদিন দোল । ভিক্টোরিয়া দত্তদের বাড়ি রং খেলা হল—আমি শালমঞ্জরী ভেঙে নিয়ে আজ প্রায় চার বৎসরের পরে বলরাম সায়েবের ঘাটে নাইতে গেলাম। বিষ্ণু প্রধান নাইচে, দোল থেলার রং সাবান দিয়ে তুলে ফেলচে। স্নান করবার সময়ে কালাঝোর পাহাড়শ্রেণীর দৃপ্ত আর সেই একটা গাছের আঁক-বাক সীমারেখা যেন ঠিক একটা ছবির মত মনে হচ্ছিল। দুপুরে খুব ঘুমিয়ে উঠে চ খেয়ে সুবর্ণরেখা পার হয়ে ওপরের জঙ্গলে বেড়াতে গেলুম। একটা গাছ ঠেস দিয়ে কতক্ষণ বসে রইলুম। পারে ব্যথা ছিল। কিন্তু বেশী হাটতে হয় নি। কালকার গাড়োয়ান স্বজন গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, তার আগে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল পঞ্চবাবুর বাংলোয় আমাদের পুরোনো চাকর কেষ্ট। স্বজন আমার গাড়িতে উঠিয়ে নিলে—তারা পাথর আনতে যাচ্চে সুবর্ণরেখার ওপারে। কতক্ষণ বসে থাকার পরে চাদ উঠল। ছোট শাল-চারার জঙ্গল—অপূৰ্ব্ব শোভা হল চাদের আলোতে কতক্ষণ জঙ্গলে এখানে ওখানে বসি, কখনও বা শুক্নো শাল পাতার রাশির ওপর শুই । সুবর্ণরেখার নদীগর্তে কতক্ষণ ওপারের পাহাড়ের আলোর মালার দিকে চেয়ে বসে রইলুম। জ্যোৎস্না পড়ে নদীখাতের শুকনো বালির রাশি চক্চক্ করচে, দূরে মৌভূাণ্ডার-এর আলো—ডাইনে টাটার আলো। ওপারের জঙ্গলের রেখা মুলাবনীর দিকে বিস্তৃত—আরক্ষণের জন্তে মনে হল ঠিক যেন ইসমাইলপুরে ঘোড়া করে জ্যোৎস্নারাত্রে বনবাউয়ের বনের পাশ দিয়ে