পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ ৩৬৩ প্রকৃতির মধ্যে কিছুক্ষণ নিরিবিলি চুপচাপ বসে চিন্তার আনন্দ উপভোগ করার জন্তে একাই গিয়ে মরাগাঙের উচু পাড়ে আইনদির বাড়ির পিছন দিকে রাস্তার ধারে বসলুম। সঙ্গে সুপ্রভার চিঠিখান ছিল। ডাইনে মরাগাঙের বাকে বাশঝাড় ও নতুন পাড়ার গোয়ালাদের বাড়ি, ওপারে আরামডাঙায় ঝিঙেফুল দুএকটা ঝিঙে ক্ষেত পেছনে একটা কাটাল গাছে কাটাল ফুলচে, খেজুর গাছে কাদি কাদি স্বর্ণবর্ণ খেজুর—সত্যিকার ট্রপিক্যাল দেশের দৃপ্ত। কলকাতা থেকে কত দূরে, কত নিভৃত, শাস্ত পল্লী অঞ্চল আমাদের এ দেশ–কেমন একটা অপরূপ শান্তি মাখানে। ভগবান যে Romance ও poetry-র উৎসমূল, তার মধ্যে যে শুধুই poetry ও Romance এ আমি বেশ অনুভব করলুম। কোথায় বিরাট হাতিলোকের স্বষ্টি, আর কোথায় এই কাদি কাদি খেজুর, ওই বেগুনী রংএর জলকচুরির ফুল, সুগন্ধ বেলফুল সবই তার মধ্যে কল্পনারূপে একদিন নিহিত ছিল। “কল্পনা স্বাষ্ট বীজঞ্চ” । কল্পনাই স্বষ্টির বীজ। “যা স্বষ্টি স্রষ্টরাঙ্গা"—কালিদাস কবি হলেও দার্শনিকের দৃষ্টি তার ছিল। আমরা সকল কবিই অল্পবিস্তর ভাবে দার্শনিক তো বটেই। অনেক সময় তারা যা দেখেন দার্শনিকেরাও তা দেখতে পান না । এখানে ক'দিন ভয়ানক বর্ষ চলচে। সকালে উঠে বেড়াতে বার হয়েচি মাছিমপুর বলে একটা গ্রামের দিকে। পাশে একটা ছোট খাল। বাঙাল মাঝির নৌকো চালাচ্চে। নারিকেল সুপারির বাগান চারিদিকে প্রত্যেক লোকের বাড়ির উঠানে, ঝুপসি বনে অন্ধকার, স্যাতসেঁতে মাটি। টিনের চালা-ওয়ালা দরমার বেড়া দেওয়া সব ঘর—তার বাইরে টিনের সাইনবোর্ড ঝুলচে, “মোজাহার আলি মোক্তার" কিংবা "আজাদ আলি, বি-এল, প্লীডার "বাড়ির পাশে ছোট ছোট ডোবা মত পুকুর—স্বপুরির বাগানটা দিয়ে ঘেরা বেড়ার আবরু। আবর্জন, পচাপাতার জঞ্জাল বাড়ির পাশেই নীচু আৰ্দ্ৰ উঠোনে বা মেজেতে। এক জায়গায় লেখা আছে রসিকলাল সেন নায়েবের বাসা । তারপর একটা সরু খালের ধারে ধারে নারিকেল মুপুরির ছায়ায় ছায়ায় কতদূর বেড়াতে গেলুম, ফিরে এসে একটা কাঠের পুলের ওপরে বসলুম। দুটি ছোট ছোট মেয়ে মাছ ধরচে। কতক্ষণ পুলটাতে বসে রইলুম। কি বিত্র জায়গা এই পিরোজপুর । পাচশো টাকা মাইনে দিয়ে যদি কেউ বলে তুমি এখানে এক বছর থাক—তা আমি কখনো থাকিনে । এমন জায়গায় মানুষ থাকতে পারে । রত্ব দেবী ও তার স্বামী সত্যিই বড় কষ্টে থাকেন, আমন আমুদে লোক বেশী দেখা যায় না। রত্নাদেবী বড় গল্পপ্রিয়—দিনরাত মুখের বিরাম নেই। আর কি সেবাযত্ন ক'দিন ? নিত্য নতুন খাবার তৈরী হচ্চে আমার খাওয়ানোর জন্তে। বৈকালে বারলাইব্রেরিতে মিটিং হল, আমার সাহিত্য-জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একঘণ্টা বক্তৃতা করা গেল। জ্যোৎস্নারাত্রে বাইরে বসে গল্প করি রত্নাদেবীর সঙ্গে । পিরোজপুর থেকে এসে মনে কোথায় একটা অযুক্তির দৈন্ত ছিল। সেখানকার সেই নারকোল স্বপুরি বনের ঝুপ সি ছায়ার স্যাতসেঁতে ভিজে উঠোন আর সুপুরির বাসলোর আবরুর কথা, সেই রসিকলাল সেন নায়েবের বাসার কথা মনে হলেই মনে একটা অস্বস্তি আসত। আমাদের দেশে আসবার সময় ঝিকরগাছা ঘাটে পৌঁছেই মনে হল স্বদেশে পৌছে গেচি। নাভারনের কাছে যশোর রোড ও বিলিতী চট্টকার ছায়া দেখে মনে হল আমরা একেবারে বাড়ি পৌঁছে গেচি। বাড়ি এলুম ন’টার গাড়িতে। এসেই খুকুর সঙ্গে দেখা । ও দেখি ওদের দাওয়ার বেড়াচ্চে, আমার দেখে প্রথমটা পিছু হটে সরে গেল, তারপরই চিনতে পেরে