পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ ՎԶՏԳ রেণু বল্পে—এইমাত্র আপনার কথা হচ্চিল। আমার হাতের নখ কেটে দিলে বসে বসে । কতক্ষণ ধরে কত গল্প হল । স্বপ্রভার কথা উঠল—খুকুর কথা উঠল। আসবার দিন ভৈরববাজারে মেঘনা নদী পার হবার সময় ট্রেনে সুপ্রভার কথা আমার কি ভীষণভাবেই মনে এসেছিল। যাবার দিন সব গ্রামের ছায়ায় স্বপুরি বনের ছায়ায় কল্যাণীকে কতবার দাড়িয়ে থাকতে দেখলুম। পূৰ্ব্ববঙ্গের মেয়েদের সঙ্গে আমার আলাপ কতকাল থেকে—মুপ্রভা, সেবা, রেণু কল্যাণী, মায়া—সবাই পূৰ্ব্ববঙ্গের মেয়ে। ওদের টানেই কতবার এখানে এলুম। সারাদিন কল্যাণী আর কল্যাণী.কত গ্রামে ওকে কল্পনা করলুম—বিদ্যাময়ী কলেজের হোস্টেল দেখে মনে হল এখানে ওরা ছিল। রত্ন দেবীর সাততলার একদিন গানের আসর হল—কোজাগরী পূর্ণিমা সেদিন। গোপালবাবু গান গাইলে—কবীরের ও মীরার ভজন। আমার মনে হল তাদের কথা, যারা আনন্দ চেয়েও পায় নি—কিম্বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ পেয়ে তাতেই খুশি হয়ে জীবন কাটিয়ে গেল। জাহ্নবী নবদ্বীপে গিয়েছিল গঙ্গাস্নান করতে, সেকথা—খুকু ডাকবাংলোর ধারে বেড়াতে গিয়েছিল—কল্যাণীরা সেদিন ঘোড়ার গাড়ি করে বারাকপুরে বেড়াতে গিয়েছিল—সে সব কথা। চোখে যেন জল এসে পড়ে। আমি ছোটবেলা থেকে কত আনন্দই পেলুম–কিন্তু আমার পরিবারের আর কেউ অত আনন্দ কোনদিন কল্পনাও করলে না। কক্সবাজারের তরুণী বন্ধু গাড়িতে যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমি তাকে 'মা' বলে ডাকলুম। পূর্ববঙ্গের মেয়ে ভিন্ন এভাবে কেউ আলাপ করত না । রেণু, কল্যাণী ও খুকুর সঙ্গে একদিন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বেড়াতে গেলুম। ওদের সীতাকুণ্ডু গ্রামে যে বাড়ি আছে, সেখানে গিয়ে উঠলুম। মধুর মা বলে একজন ব্রাহ্মণ বিধবা আমাদের আদর-যত্ন করলেন। মুপুরির গুড়ির সাকো দিয়ে পার হয়ে রেণু ও আমি অতি কষ্টে মধুর মার বাড়ি গিয়ে পৌছুই। আমি তামাক খাচ্চি হকোয় (মধুর মা সেজে দিল) দেখে রেণু তো হেসেই অস্থির। বুদ্ধ, তার ক্যামেরাতে সেই অবস্থায় আমার ফটাে নিলে। আরও অনেক ফটো নেওয়া হল পাহাড়ে উঠবার পথে। রেণু কেবল বলে—আপনার জন্তে আমার ভয় । আমি বলি—আর কোন ভয় নেই—চল উঠে, কি মুন্দর দৃশ্ব, কি খামল বনানী, বিরাট বনস্পতিদের ভিড়। শম্ভুনাথের মন্দিরের কাছে রেণু, কল্যাণী ওরফে চঞ্চু জল খেয়ে নিল। যেমন আমি বলি চঞ্চু, রেণু অমনি বলে, ‘বাহির হইল! চঞ্চল বাহির হইল! অর্থাৎ আমার গ্রাম্যজীবনের লেখক হবার সেই আশ্চৰ্য্য ঘটনাটির কথা । একটা গাছের ফটো নিতে গিয়ে ওদের জোকে ধরলে। জোক অবস্তি আমাকেও ধরেছিল । আসবার পথে ওরা তেঁতুল পাড়লে একটা গাছ থেকে—তারপর ওদের বাড়ি এসে সবাই ভাত খাওয়া গেল সন্ধ্যাবেলা। রেণু বল্লে —আপনার সঙ্গে এ সম্পর্ক আর কখনও জীবনে পাব না ! কত গল্প করতে করতে রাত্রি ন’টার সময় চাটগ এলুম। রত্ন দেবী খাবার করে নিয়ে বসে আছেন—ভাগ্যে আজ সীতাকুণ্ডে থাকি নি । তার পরদিন সকালে উঠে কেশব জিনিস নিয়ে স্টেশনে এল। রেণুর বই কেশবের হাতে দিয়ে দিলুম। চন্দ্রনাথের পাহাড় ধুম স্টেশন থেকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে গিয়েচে একেবারে হিমালয় পৰ্য্যন্ত । কি নিবিড় ঘন বনানী পাহাড়ের মাথার। ওই একটা বিভিন্ন জগৎ যেন। ব্রাহ্মণবেড়িয়া স্টেশনে আসবার সময় মনে হল অনেক আগে একবার এ পথে গিয়েছিলুম —তখন আমার কি ছিল ? এখন কত কে আছে—সুপ্রভা আছে, কল্যাণী আছে, খুকু আছে। ময়মনসিং স্টেশনে আসবার আগে এল বৃষ্টি। আজ কিন্তু ময়মনসিং স্টেশন ছাড়তেই গারো পাহাড় বেশ দেখা যায়—বিদ্যাগঞ্জ বলে একটা স্টেশন থেকে চমৎকার দেখা গেল !