পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ રજે আমার মনের ভাষা বাক্য খুঁজে পেল না প্রকাশের—মনেই রয়ে গেল। বাবাকে সবাই মিলে বাধলে ! আহ, কি কষে কষেই বাধলে । অল্প দড়ি কোথাও পাওয়া গেল না যা ছিল না—জ্যাঠামশায়দের খিড়কি-পুকুর ধারের গোয়াল-বাড়ি থেকে গরু বাধবার দড়ি নিয়ে এল— তাই দিয়ে বাধা হ’ল । আমার মনে হ’ল অতটা জোর ক'রে বাবাকে বাধবার দরকার কি ! বাবার হাতের শির দড়ির মত ফুলে উঠেছে যে ! সেজ কাকাকে চুপিচুপি বললুম—কাকাবাবু, বাবার হাতে লাগচে, অত ক’রে বেঁধেচে কেন ? বলুন না ওদের ? কাক সে কথা জ্যাঠামশায়কে ও নিতাইয়ের বাবাকে বলতে তারা বললেন—তুমিও কি থেপলে নাকি রমেশ ? হাত আলগা থাকবে পাগলের ?...তা হলে পা খুলতে, কতক্ষণ—তার পরে আমার দিকে চেয়ে জ্যাঠামশায় বললেন—যাও জিতু বাবা-তুমি বাড়ির ভেতরে যাও— —নয়তো এখন বাইরে গিয়ে বসে । আবার বাবার হাতের দিকে চেয়ে দেখলুম—দড়ির দাগ কেটে বসে গিয়েছে বাবার হাতে । সেই রকম তুলোমাথা অদ্ভুত মূৰ্ত্তি : বাইরে গিয়ে আমি এক গায়ের পেছনের মাঠের দিকে চলে গেলুম—একটা বড় তেঁতুল গাছের তলায় সারা দুপুর ও বিকেল চুপ করে বসে রইলুম। দিন কতক এই ভাবে কাটল । তারপর পাড়ার দু-পাচজন লোক এসে জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে কি পরামর্শ করলে। বাবাকে কোথায় তারা নিয়ে গেল, সবাই বললে কলকাতায় হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তারা ফিরেও এল, শুনলুম, বাবাকে নাকি হাসপাতালে ভৰ্ত্তি করে নিয়েছে। শীগ গীরই সেরে বাড়ি ফিরবেন। আমরা আশ্বস্ত হলুম। দশ-বারে দিন পরে একদিন বিকেলের দিকে আমি ও সীতা পথে খেলা করচি, এমন সময় সীতা বললে—ঐ যে বাবা “দূরে পথের দিকে চেয়ে দেখি বাবাই বটে। ছুটে আমরা বাড়িতে মাকে খবর দিতে গেলুম। একটু পরে বাবা বাড়ি ঢুকলেন—এক হাটু ধুলো, রুক্ষ চুল । ওপর থেকে জ্যাঠাইমা নেমে এলেন, কাকারা এলেন । বাবাকে দেখে সবাই চটে গেলেন। সবাই বুঝতে পারলে বাবা এখনও সারেন নি, তবে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসার কি দরকার ? - বাবা একটু বসে থেকে বললেন, ভাত আছে ? কাল ঐ দিকের একটা গায়ে দুপুরে দুটো খেতে দিয়েছিল, আর কিছু খাই নি সারাদিন, খিদে পেয়েছে । কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে আসচি—ছেলেপিলে ছেড়ে থাকতে পারলাম না—চলে এলাম । একটু পরেই বোঝা গেল বাবা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছেন এবং যেমন পাগল তেমনি আছেন । এবার আমাদের রাগ হ’ল—মায়ের কথা বলতে পারিনে, কারণ তাকে রাগ প্রকাশ করতে কখনও দেখিনি–কিন্তু আমি সীতা দাদা তিন ভাইবোনে খুব চটলাম । আমাদের চটবার কারণও আছে—খুব সঙ্গত কারণই আছে। আমাদের প্রাণ এখানে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বাবা আবার পুরোমাত্রায় পাগল হয়ে উঠলেন—তিনি দিনরাত বসে বসে বকেন আর কেবল খেতে চান। মা দুটি বাসি মুড়ি, কোনো দিন বা ভিজে চাল, কোনো দিন শুধু একটু গুড়–এই খেতে দেন। তাও সব দিন বা সব সময় জোটানো কষ্টকর। আমরা দুপুরে খাই তো রাতে আর কিছু খেতে পাইনে-নয়ত সারাদিন পরে হয়ত সন্ধ্যার সময় খাই। মা কোথা থেকে চাল যোগাড় করে আনেন আমরা জানিনে—কখনও জিজ্ঞেসও করিনি। কিন্তু বাড়িতে আর আমাদের তি}বার জে নেই। বাড়িসুদ্ধ লোক আমাদের