পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ లి বাপু মোটের ওপর একদিন স্কুলে দাদা এসে বললে—সকাল সকাল বাড়ি চল আজ জিতুআজ বাবাকে আড়াগায়ে জলার ধারে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে-তুই, আমি, নিতাই, সিধু আর মেজকাক যাব । একটু পরে আমি ছুটি নিয়ে বেরুলাম। গিয়ে দেখি মা দালানে বসে কাদচেন, আমরা যাবার আগেই নিতাই এসে বাবাকে নিয়ে গিয়েছে। আমরা খানিক দূরে গিয়ে ওদের নাগাল পেলাম—পাড়ার চার-পাচজন ছেলে সঙ্গে আছে, মধ্যিখানে বাবা । ওরা বাবার সঙ্গে বাজে বকছে—শিকারের গল্প করচে, বাবাও খুব বকচেন । নিতাই আমাকে বাবার সামনে যেতে বারণ করাতে আমি আর দাদা পেছনেই রইলাম। ওরা মাঠের রাস্ত ধরে অনেক দূর গেল, একটা বড় বাগান পার হ’ল, বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঘেমে আমরা সবাই নেয়ে উঠলাম। রোদ যখন পড়ে গিয়েছে তখন একটা বড় বিলের ধারে সবাই এসে পৌঁছলাম। নিতাই বললে— এই তো আড়াগায়ের জলা—চল, বিলের ওপারে নিয়ে যাই—ওই হোগলা বনের মধ্যে ছেড়ে দিলে আর পথ খুঁজে পাবে না রাত্তিরে। আমরা কেউ ওপারে গেলুম না-গেল শুধু সিধু আর নিতাই। খানিকটা পরে ওরা ফিরে এসে বললে, চল পালাই—তোর বাবাকে একট। সিগারেট খেতে দিয়ে এসেছি—বসে বসে টানচে । চল ছুটে পালাই— সবাই মিলে দৌড় দিলাম। দাদা তেমন ছুটতে পারে না, কেবলই পেছনে পড়তে লাগল। সন্ধ্যার ঘোরে জলা আর জঙ্গলের মধ্যে পথ খুঁজে পাওয়া যায় না—এক প্রহর রাত হয়ে গেল বাড়িতে পৌছুতে। কিন্তু তিন দিনের দিন বাবা আবার বাড়ি এসে হাজির। চেহারার দিকে তাকানো যায় না—কাদামাখা ধুলোমাখা অতি বিকট চেহারা। বেল না কি ভেঙে খেয়েছেন—সারা মুখে, গালে বেলের আঠা ও শাস মাখানো। মা নাইয়ে ধুইয়ে ভাত খেতে দিলেন, বাবা খাওয়া-দাওয়ার পর সেই যে বিছানা নিলেন, দু দিন চার দিন ক’রে ক্রমে পনের দিন কেটে গেল, বাবা আর বিছানা থেকে উঠলেন না । লোকটা যে কেন বিছানা ছেড়ে ওঠেন না—তার কি হয়েছে—এ কথা কেউ কোনদিন জিজ্ঞেসও করলে না। মা যেদিন যা জোটে খেতে দেন, মাঝে মাঝে নাইয়ে দেন–পাড়ার কোন লোকে উকি মেরেও দেখে গেল না । জ্যাঠামশাইরা হতাশ হয়ে গিয়েছেন । তারা আর আমাদের সঙ্গে কথা কন না, তাদের ঘরে-দোরে ওঠা আমাদের বন্ধ। আমরা কথা বলি চুপি চুপি, চলি পা টিপে টিপে চোরের মত, বেড়াই মহা অপরাধীর মত—পাছে ওঁরা রাগ করেন, বিরক্ত হন, আবার ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে আসেন। একদিন না খেয়ে স্কুলে পড়তে গিয়েছি—অষ্ঠ দিনের মত টিফিনের সময় সীতা খাবার জন্যে ডাকতে এল না। প্রায়ই আমি না খেয়ে স্কুলে আসতাম, কারণ অত সকালে মা রান্না করতে পারতেন না—রান্না শুধু করলেই হ’ল না, তার যোগাড় করাও তো চাই। মা কোথা থেকে কি যোগাড় করতেন, কি ক’রে সংসার চালাতেন, তিনিই জানেন । আমি কখনও তা নিয়ে ভাবি নি। আমি ক্ষুধাতুর অবস্থার বেলা একটা পর্যন্ত ক্লাসের কাজ করে যেতাম আর ঘন ঘন পথের দিকে চাইতাম এবং রোজই একটায় টিফিনের সময় সীতা এসে ডাক দিত—দাদা, ভাত হয়েচে থাবে এসো । এদিন কিন্তু একটা বেজে গেল, দুটো বেজে গেল, সীতা এল না। ক্লাসের কাজে আমার আর মন নেই-আমি জানলা দিয়ে ঘন ঘন বাইরে পথের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখচি। আরও আধ ঘণ্টা কেটে গেল, বেলা আড়াইট । এমন সময় কলুদের দোকানঘরের কাছে সীতাকে