পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হয়, আমাদের বেলাতেও তাই হয়েছে। আমাদের মধ্যে দাদা সকলের চেয়ে সুন্দর—যেমন রঙ, তেমনই চোখমুখ, তেমনই চুল—তারপর সীতা, তারপর আমি। দাদা যে মুন্দর, এ-কথা শক্ৰতেও স্বীকার করে—সে আগে থেকে ভাল চোখ, ভাল মুখ, ভাল রঙ দখল ক'রে বসেছে— আমার ও সীতার জন্তে বিশেষ কিছু রাখে নি। তা হলেও সীতা দেখতে ভাল। তা ছাড়া আবার শৌর্থীন—সৰ্ব্বদা ঘষে মেজে, খোপাটি বেঁধে, টিপটি পরে বেড়ানো তার স্বভাব। কথা বলতে বলতে দশবার খোপায় হাত দিয়ে দেখছে খোপা ঠিক আছে কি-না। এ নিয়ে এ-বাড়িতে তাকে কম কথা সহ করতে হয় নি। কিন্তু সীতা বিশেষ কিছু গায়ে মাথে না, কারুর কথা গ্রাহের মধ্যে আনে না—চিরকালের একগুঁয়ে স্বভাব তার । 象 আমার মনে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, আমাদের তো পয়সা নেই, সীতাকে তেমন ভাল ঘরে বিয়ে দিতে পারব না—এই সব পাড়াগায়ে আমার জ্যাঠামশায়দের মত বাড়িতে, আমার জ্যাঠাইমার মত শাশুড়ীর হাতে পড়বে—কি দুর্দশাটাই যে ওর হবে । ওর এত বই পড়ার বোক যে, এ-পাড়ার ওপাড়ার বেী-বিদের বাক্সে যত বই আছে চেয়ে-চিন্তে এনে এ-সংসারের কঠিন কাজের ফঁাকে ফঁাকে সব পড়ে ফেলে দিয়েচে । জ্যাঠাইমা তো এমনিই বলেন, “ও-সব অলুক্ষণে কাণ্ড বাপু—মেয়ে-মানুষের আবার অত বই পড়ার শখ, অত সাজগোজের ঘটা কেন ? পড়বে তেমন শাশুড়ীর হাতে, বীটার আগায় বই পড়া ঘুচিয়ে দেবে তিন দিনে।" সীতার বুদ্ধি খুব । শতগল্প বলে একখানা বই ও কোথা থেকে এনেছিল, তাতে 'সোনামুখী ও ছাইমুখী’ বলে একটা গল্প আছে, সৎমার সংসারে গুণবতী লক্ষ্মীমেয়ে সোনামুখী বাঁটা লাথি থেয়ে মানুষ হ’ত—তারপর কোন দেশের রাজকুমারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল ভগবানের দয়ায়—সীতা দেখি গল্পটার পাতা মুড়ে রেখেছে। ও-গল্পটার সঙ্গে ওর জীবনের মিল আছে, এই হয়ত ভেবেছে। কিন্তু সীতা একটি কথাও মুখ ফুটে বলে না কোন দিন। ভারি চাপা । সীতা বই থেকে চোখ তুলে পথের দিকে চেয়ে বললে—ঐ হীরুঠাকুর আসচে দাদা, আমি পালাই— আমি বললাম—বোস, হীরুঠাকুর কিছু বলবে না। ও ঠিক আজ এখানে খাবার কথা বলবে দ্যাখ, । হীরুঠাকুরকে এগায়ে আসা পৰ্য্যন্ত দেখছি। রোগা কালো চেহারা, খোচা খোচা একমুখ কাচা-পাকা দাড়ি, পরনে থাকে আধময়লা থান, খালি পা, কাধে ময়লা চাদর, তার ওপরে একখানা ময়লা গামছা ফেলা। নিজের ঘরদোর নেই, লোকের বাড়ি বাড়ি খেয়ে বেড়ানো তার ব্যবসা। আমরা যখন এখানে নতুন এলাম, তখন কতদিন হীরুঠাকুর এসে আমাকে বলেছে, “তোমার মাকে বল খোক, আমি এখানে আজ দুটো খাবে।" মাকে বলতেই তখুনি তিনি রাজী হতেন—ম চিরকাল এমন ছিলেন না, লোককে খাওয়াতে-মাখাতে চিরদিনই তিনি ভালবাসেন । আমার কথাই ঠিক হ’ল। হীরুঠাকুর এলে বললে—“শোন খোক, তোমার মাকে বলে। আমি এখানে আজ দুপুরে চাট্ট ভাত খাবো।” সীতা বই মুখে দিয়ে খিলখিল ক'রে হেসেই খুন। আমি বললাম, “হীরু-জ্যাঠা, আজকাল তো আমরা আলাদা খাইনে। জ্যাঠামশায়দের বাড়িতে খাই, বাবা মারা গিয়ে পৰ্যন্ত। আপনি সেজকাকাকে বলুন গিয়ে । সেজকাকা কাটালতলার নাপিতের কাছে দাড়ি কামাচ্ছেন।" সেজকাকা লোক ভাল। হীরুঠাকুর আশ্বাস পেয়ে আমাদেরই ঘরের বারান্দায় বসল।