পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ Qぬ —তবে সেদিন ও ঘরে এলেন, আমার সঙ্গে কথা বললেন না তো! চলে গেলেন কেন ? মরীয়া হয়ে বললাম—আপনাকে সেদিন চিঠি দেবে বলে এসেছিলাম, কিন্তু পাছে কিছু মনে করেন, সেজন্তে দেওয়া হয়নি। পাছে কিছু মনে করেন ভেবেই বাড়ির মধ্যে আসিনে । তিনি খানিকক্ষণ চুপ ক’রে রইলেন। তার পর মৃদুস্বরে বললেন—মাথা ঠাণ্ডা করে লেখাপড়া করুন। কেন ও রকম করেন ? আর বাড়ির মধ্যে আসেন না কেন ? ওতে আমার মনে ভারি কষ্ট হয়। যেমন আসতেন তেমনি আসবেন বলুন ? আমায় ভাবনার মধ্যে ফেলবেন না ও রকম । আমার শরীরে যেন নতুন ধরনের অনুভূতির বিদ্যুৎ খেলে গেল । সেখানে আর দাড়াতে পারলাম না—মুখে যা এল, একটা জবাব দিয়ে নীচে নেমে এলাম। সারারাত্র আর ঘুমুতে পারিনে। আমার জন্যে একজন ভাবে এ চিন্তার বাস্তবতা আমার জীবনে একেবারে নতুন। নতুন নেশার মত এ অনুভূতি আমার সারা দেহযন অভিভূত করে তুললে । কি অপূৰ্ব্ব ধরনের আনন্দ-বেদনায় মাখানে দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস ! দিন রাতে সব সময়ই আমার ওই এক চিন্তা। নির্জনে কাটাই, কিছু ভাল লাগে না, অথচ র্যার চিন্তা শয়নে-স্বপনে সৰ্ব্বদাই করি, পাছে তার সামনে পড়ি এই ভয়ে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করি । লেখাপড়, খাওয়া, ঘুম সব গেল। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি ছোটবৌঠাকুরুনের হ’ল অমুখ। অমুখ ক্রমে বাড়াবাড়ি ধরনের হ’ল। , চাতরা থেকে যদু ডাক্তার দেখতে এল। তার বাপের বাড়ি থেকে লোকজন এসে পড়ল—বাড়িমৃদ্ধ লোকের মুথে উদ্বেগের চিহ্ন। আমি ডাক্তার ডাক, ওষুধ আন এ সব করি বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে, কিন্তু একদিনও রোগীর ঘরে যেতে পারলাম না— কিছুতেই না। একদিন ঘরের দোরের কাছে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম—কিন্তু চৌকাঠের ওপারে যাইনি । ক্রমে তিনি সেরে উঠলেন । একদিন আমার "চয়নিকা'খানা তিনি চেয়ে পাঠালেন— দিন-দুই পরে কালো বই ফিরিয়ে দিয়ে গেল। চার-পাচ দিন পরে 'চয়নিকা-খানা কি জন্তে খুলতে গিয়েচি, তার মধ্যে একখানা চিঠি, ছোটবৌঠাকুরুনের হাতে লেখা । নাম নেই কারুর । লেখা আছে--- "আমার অমুখের সময় সবাই এল, আপনি এলেন না কেন ? আমি কত আশা করেছিলাম যে আপনি দেখতে আসবেন, জানেন তা ? আমার মরে যাওয়াই ভাল । কেন যে আবার সেরে উঠলাম। অসুখ থেকে উঠে মন ও শরীর ভেঙে গেছে। কালোর মুখে শুনেচি, আপনি ঘরে টাঙিয়ে রেখেচেন যীশুখৃষ্ট্রের ছবি, তিনি হিন্দুর দেবতা নন্‌—কিন্তু আপনি যাকে ভক্তি করেন—আমি তাকে অবহেলা করতে পারিনে । আমার জন্তে র্তার কাছে প্রার্থনা করবেন ! আর-একটা কথা—একটিবার দেখতে কি আসবেন না ?” যীশুখৃষ্ট্রের ছবির দিকে চাইলাম। সম্প্রতি একথানা বুদ্ধের ছবি, আর একখানা চৈতন্তের ছবিও এনে টাডিয়েছিলাম। রোগশীর্ণ পত্ৰলেখিকার করুণ আকৃতি ওদের চরণে পৌছে দেবার ভার আমার ওপর পড়েচে । কিন্তু আমি কি পারব ? অমুকম্পায় মমতায় আমার মন তখন ভরে উঠেচে । যে প্রার্থনা ওদের কাছে জানলাম, তা ভাষাহীন, বাক্যহীন। আমি এছাড়া আর কিছু করতে পারিনে। সামনে হঠাৎ যেতে পারব না তার। এ-বাড়িতেও আর বেশিদিন থাকা হবে না আমার । চলে যাব এখান থেকে । টেস্ট পরীক্ষা দিয়েই আটঘরায় পালাবো, ঠিক করলাম। সেখানে যাইনি অনেক দিন ।