পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ *も “জিতু, আমার বড় মনে কষ্ট, বিয়ের সময় তোকে খবর দিতে পারিনি। তুই একবার অবিপ্তি অবিপ্তি আসবি, তোর বউদিদির বড় ইচ্ছে তুই একবার আসিস। মায়ের সম্বন্ধে কি করি আমায় লিখবি । সেখানে তোর বউদিকে নিয়ে যেতে আমার সাহসে কুলোয় না । ওরা ঠিক কুলীন ব্রাহ্মণ নয়, আমাদের স্বঘরও নয়, অত্যন্ত গরিব, আমি বিয়ে না করলে মেয়েটি পার হবে না সবাই বললে, তাই বিয়ে করেচি। কিন্তু তোর বৌদিদি বড় ভাল মেয়ে, ওকে যদি জ্যাঠামশায় ঘরে নিতে না চান, কি অপমান করেন, সে আমার সহ হবে না --” পত্র পড়ে বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই হ’ল । দাদা সংসারে বড একা ছিল, ছেলেবেলা থেকে আমাদের জন্তে খাটচে, জীবনটাই নষ্ট করলে, সেজন্তে অথচ ওর দ্বারা না হ’ল বিশেষ কোনো উপকার মায়ের ও সীতার, না হ’ল ওর নিজের । ভালই হয়েচে ওর মত স্নেহপ্রবণ, ত্যাগী ছেলে যে একটি আশ্ৰয়নীড পেয়েছে, ভালবাসার ও ভালবাসা পাবার পাত্র পেয়েচে, এতে ওর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলুম। কত রাত্রে শুয়ে শুয়ে দাদার দুঃখের কথা ভেবেচি ! মকে কাছে নিয়ে আসতে পত্র লিখে দিলাম দাদাকে । জ্যাঠামশায়ের বাডিতে রাখবার আর দরকার নেই। আমি শীগগিরই গিয়ে দেখা করবো। মাঘ মাসের প্রথমে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মনে কেমন একটা উদাস ভাব, কিসের একটা অদম্য পিপাসা । আমার মনের সঙ্গে যা খাপ খায় না, তা আমার ধৰ্ম্ম নয়। ছেলেবেলা থেকে আমি যে অদৃশ্য জগতের বার বার সম্মুখীন হয়েচি, অথচ যাকে কখনও চিনিনি, বুঝিনি—তার সঙ্গে যে ধৰ্ম্ম খাপ খায় না, সেও আমার ধৰ্ম্ম নয়। অথচ চারদিকে দেখচি সবাই তাই। তারা সৌন্দৰ্য্যকে চেনে না, সত্যকে ভালবাসে না, কল্পনা এদের এত পঙ্গু যে, যে-খোটায় বদ্ধ হয়ে ঘাসজল খাচ্চে গরুর মত—তার বাইরে উদ্ধের নীলাকাশের দেবতার যে-স্বষ্টি বিপুল ও অপরিমেয় এরা তাকে চেনে না। বছরখানেক ঘুরে বেড়ালুম নানা জায়গায় । কতবার ভেবেচি একটা চাকরি দেখে নেবো, কিন্তু শুধু ঘুরে বেড়ানো ছাড আর কিছু ভাল লাগতো না। যেখানে শুনতাম কোনো নতুন ধৰ্ম্মসম্প্রদায় আছে, কি সাধুসন্ন্যাসী আছে, সেখানে যেন আমায় যেতেই হবে, এমন হয়েছিল। কালনার পথে গঙ্গার ধারে একদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। কাছেই একটা ছোট গ্রাম, চাষীকৈবৰ্ত্তের বাস । ওখানেই আশ্রয় নেবো ভাবলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খড়ের ঘর, বেশ নিকানো পুছোনো, উঠোন পৰ্য্যন্ত এমন পরিষ্কার যে সিছর পড়লে উঠিয়ে নেওয়া যায়। সকলের ঘরেই ধানের ছোটবড গোল, বাডির সাম্নে-পিছনে ক্ষেত-খামার । ক্ষেতের বেড়ায় মটরশুটির ঝাড়ে সাদা গোলাপী ফুল ফুটে মিষ্টি সুগন্ধে সন্ধ্যার অন্ধকার ভরিয়ে রেখেচে । একজন লোক গোয়ালঘরে গরু বধেছিলো। তাকে বললাম—এখানে থাকবার জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে ? সে বললে—কোখেকে আসা হচ্চে ? আপনারা ? ‘ব্রাহ্মণ শুনে নমস্কার করে বললে—ওই দিকে একটু এগিয়ে যান—আমাদের অধিকারী মশাই থাকেন, তিনি ব্রাহ্মণ, র্তার ওখানে দিব্বি থাকার জায়গা আছে । একটু দূরে গিয়ে অধিকারীর ঘর। উঠোনের এক পাশে একটা লেবুগাছ। বড় আটচালা ঘর, উচু মাটির দাওরা একটি ছোট ছেলে বললে, অধিকারী বাড়ি নেই, হলুদপুকুরে কীৰ্ত্তনের বায়না নিয়ে গাইতে গিয়েচে—কাল আসবে । আমি চলে যাচ্ছি এমন সময় একটি মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে বললে—চলে কেন যাবেন ? পায়ের ধুলো দিয়েছেন যদি রাতে এখানে থাকুন না কেনে ?