পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১১৪ বিভূতি-রচনাবলী এই বালকের মাকে সে একদিন আনিয়া তুলিয়াছিল। তেলিদের বাড়ি হইতে চাবি আনিয়া ঘরের তালা খলিয়া ফেলিল । খড় নানান্থানে উড়িয়া পড়িয়াছে, ইন্দরের গত্ত, পাড়ার গরু-বাছুর উঠিয়া দাওয়া ভাঙিয়া নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে, উঠানে বনজঙ্গল । কাজল চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া অবাক হইয়া বলিল, বাবা, এইটে তোমাদের বাড়ি ? আপ হাসিয়া বলিল--তোমাদেরও বাড়ি বাবা । মামার বাড়ির কোঠা দেখেছ জন্মে অবধি, তাতে তো চলবে না, পৈতৃক সম্পত্তি তোমার এই ৷ সকালে উঠিয়া একটি খবরে সে স্তম্ভিত হইয়া গেল । নিরুপমা আর নাই । সে গত পৌষ মাসে তীৰ্থ করিতে গিয়াছিল, পথে কলেরা হয়, সেখানেই মারা যায়। নিরুপমার জ্যাঠা বন্ধ সরকার মহাশয় বলিতেছেন –আর দাদাঠাকুর, তোমরা লেখাপড়া শিখে দেশে তো আর আসবে না ? মেয়েটার কথা মনে হলে আর অন্ন মুখে ওঠে না । হ’ল কি জান, বললে কুড়লের পাটে মেলা দেখতে যাব । তার তো জানো পুজো-আচ্চা এক বাতিক ছিল। পাড়ার সবাই যাচ্ছে, আমি বলি, তা যাও । ওমা, তিনদিন পর সকালে খবর এল নির মা মর-মর, শাস্তিপরের পথে একটা দোকানে কি সমাচার, না কলেরা । গেলম সবাই ছুটে । পৌছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল । আমরা যখম গেল,ম তখন বাকরোধ হয়ে গিয়েছে, চিনতে পারলে, চোখ দিয়ে হ-হ জল পড়তে লাগল। দাদাঠাকুর-মা আমার পাড়াসন্ধ সবারই উপকার করে বেড়াত তুমি সবই জান—আর অসুখ দেখে সেই পাড়ার লোকই---যারা সঙ্গে ছিল, পথের ধারের একটা দোচালা ভাঙা ঘরে মাকে আমার ফেলে সবাই পালিয়েছে। পাশের দোকানীটা লোক ভাল-সে-ই একটু দেখাশনা করেছে। চিকিৎসে হয় নি, পত্তরও হয় নি, বেখোরে নির-মাকে হারালম । সরকার-বাড়ি হইতে ফিরিতে একটু বেলা হইয়া গেল। উঠানে পা দিয়া ডাকিল ও খোক-কাযল দাপরে ঘ,মাইতেছিল, কখন ধর্ম ভাঙিয়া উঠিয়াছে এবং তেলি-বাড়ি হইতে অকেশি যোগাড় করিয়া আনিয়া উঠানের গাছের চাঁপা ফুল পাড়িবার জন্য নিচের একটা ডালে অাঁকশি বাধাইয়া টানাটনি করিতেছে । দশ্যটা তাহার কাছে অদ্ভুত মনে হইল । অপণার পোঁতা সেই চাঁপাফুল গাছটা । কবে তাহার ফুল ধরিয়াছে, কবে গাছটা মানুষ হইয়াছে, গত সাত বৎসরের মধ্যে অপর সে খোঁজ লওয়ার অবকাশ ছিল না—কিন্তু খোকা কেমন করিয়া -- সে বলিল—খোকা ফুল পড়েছিস তো, গাছটা কে পতেছিল জানিস ? কাজল বাবার দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল—তুমি এসো না বাবা, ঐ ডালটা চেপে ধরো না ! মোটে দুটো পড়েছে। o অপ বলিল—কে প:তেছিল জানিস গাছটা ? তোর মা. কিন্তু মা বলিলে কাজল কিছুই বোঝে না । জ্ঞান হইয়া অবধি সে দিদিমা ছাড়া আর কাহাকেও চিনিত না, দিদিমাই তাহর সব । মা একটা অবাস্তব কাল্পনিক ব্যাপার মাত্র। মায়ের কথায় তার মনে কোনও বিশেষ সুখ বা দুঃখ জাগায় না। অনেকদিন পরে মনসাপোতা আসা। সকলেই বাড়িতে ডাকে, নানা সদপদেশ দেয়। ক্ষেত্র কপালী অপরকে ডাকিয়া অনেকক্ষণ কথাবাত্ত কহিল, দুধ পাঠাইয়া দিল—ঘর ছাইবার জন্য ভড়েরা এক গাড়ি উলখেড় দিতে চাহিল। রাত্রে আবার কি কাজে সরকার-বাড়ির সামনের পথদিয়া আসিতে হইল। বাড়িটার দিকে যেন চাওয়া যায় না । গোটা মনসাপোতাটা নিরদির অভাবে ফাঁকা হইয়া গিয়াছে তাহার কাছে। নিরদি, আজ থোকাকে নিয়ে এসেছি, তুমি এসে ওকে দেখবে না, আদর করবে না, খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত ক'রে দেবে না ?