পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/১৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৯২ বিভূতি-রচনাবলী এমন ধরনের অাঁকাজোকা কলসীর গায়ে । এসব বাবাঠাকুর অনেক কাল আগের জিনিস । এ পোড়ই আলাদা—খবে ওস্তাদ কুমোর না হলে এমন পোড় হবে না বাবাঠাকুর । গড়ের খালের খুব নিচের দিকে, যেখানে জল প্রায় মজে এসেছে, সেখানে একদিন মাছ ধরতে বসে কেদার কলসীটা দেখতে পেয়েছিলেন । ওঃ, টাকার কলসী পেয়ে গিয়েছেন বলে কি খুশি কেদারের ! শরতের মা লক্ষীমণি তখনও বেচে । লক্ষী ছটে এল—কি গা কলসীটাতে ? এর আগে কেদার বলে গিয়েছিলেন যে একটা কলসীর কানা বেরিয়েছে গড়ের খালের পাড়ে। অনেক নিচের দিকে পাড়ের । কেদার হাসতে হাসতে বললেন, এক হাঁড় মোহর—নেবে এসো— লক্ষীর বয়স তখন পয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম নয়, কিন্তু দেখাতো প’চিশ বছরের যাবতীর মত । গায়ের রঙের জলসে এই দু-বছর আগেও মরণের দিনটি পয্যন্ত ছিল অমান । এই মেয়ে হয়েছে ওর মায়ের মত অবিকল—কিন্তু লক্ষীর মত অত জলসে নেই গায়ের রঙের— তার কারণ কেদার নিজে তত ফস"া নন—শ্যামবণ । লক্ষয়ী এসে হাসিমুখে কড়িগুলো নিয়ে গেল। বললে, জানো না লক্ষরি কড়ি, পয়মন্ত কড়ি—আমাদের বংশের কেউ হয়তো পতে রেখে থাকবে কতকাল আগে—যত্ন করে তুলে রেখে দিই— কেদার জিজ্ঞেস করলেন মেয়েকে—ভালো কথা, কলসীর সেই কড়িগুলো কোথায় আছে ? —লক্ষীর হাঁড়ির মধ্যে মা-ই তো রেখে গিয়েছিল, সেখানেই আছে । কেদারের মনটা আজ হঠাৎ কেমন আদ্র হয়ে উঠেছে, আশ্চয্যের ব্যাপার বটে ! তিনি একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন, দেখে এসো না মা, আছে তো ঠিক—যাও না— অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শরৎ মুখের হাসি গোপন করলে, আহা, হাসিও পায়, দুঃখও হয় বাবার জন্যে । মা মারা যাবার পরে বাবা মায়ের কোন জিনিস ফেলতে পারেন না, মায়ের ভাঙা চিরনিখানা পয্যন্ত । তবে সব সময় তো খেয়াল থাকে না, ভোলা মহেশ্বরের মত বাইরে বাইরে ঘোরেন কিন্তু মাঝে মাঝে হয়তো মনে পড়ে যায় । শরতের বয়স হ'ল প“চিশ-ছাবিশ—সে সব বোঝে । বাবাকে সাস্তবনা দেওয়ার জন্যেই বিশেষ করে শরৎ উঠে গেল লক্ষীর হাঁড়ি দেখতে— সে ভালরকমই জানে—কড়িগুলো আছে ওর মধ্যে । কিন্তু বাবার ছেলেমানষের মত স্বভাব, যখন যা ধরবেন তাই । {s সে দেখে ফিরে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে কেদার জিজ্ঞেস করলেন, রয়েছে দেখলি ? শরৎ আশ্বাস দেওয়ার সরে বললে, হ’্যা বাবা, রয়েছে । —আর সেই কলসীটা কালই নিয়ে আয় ওদের বাড়ি থেকে । সেখানে এত –দিন ফেলে রাখে ? তোর জিনিসপত্রের যত্ন নেই । —তুমি ভেবো না বাবা, কালই আনবো । আজ বাবার হঠাৎ খেয়াল চেপেছে তাই, নইলে আজ পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে কোনো দিন কলসীটার কথা বাবা তো এক দিনও বলেন নি। আজও তো সে-ই আগে তুলেছিল ওকথা, তাই এখন বাবার বড় দরদ কলসীর ওপর, কড়ির ওপর। কেদার নিশ্চিন্ত হয়ে এক ছিলিম তামাক ধরালেন । কলসীর কথা ওঠাতে তাঁর মনে পড়লো, বনে-জঙ্গলে ঘোরেন তিনি এই বিশাল গড়ের হাতার মধ্যে, খালের এপারে বা ওপারে জলের মধ্যে আরও দু-একটা জিনিস দেখেছেন, যার অর্থ তিনি করতে পারেন নি ।