পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৪৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ఆషి বিভূতি-রচনাবলী গোটাকয়েক গল্প ও কবিতা দেবো—পড়ে দেখবেন কেমন হয়েচে । কলকাতার ওই বাবদেরও দেখাবেন । আমি উৎসাহের সঙ্গে বলি—নিশ্চয়ই । বাঃ চমৎকার লেখা তোমার। পড়ে সেখানে সবাই কি খুশি ! তা এনো। আসচে হাটবারেই এনো। তার আর কথা কি ! ও বললে—ফিরবেন তো এমন সময় ? আমি লেখা নিয়ে এই বটতলায় বসে থাকবো । আসবেন একটু সকাল-সকাল যদি পারেন—দু-একটা লেখা একটু পড়ে শোনাবার ইচ্ছে— আমি ওর মাখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম—শোনাবে নাকি ? বাঃ তবে তো বেশ দিনটা কাটবে। নিশ্চয়ই আসবো। তোমার কথা কত হয় কলকাতায় বন্ধবোন্ধবদের মধ্যে। বেচারীকে সত্যি কথা বলে লাভ নেই । ওতেই ওর সখে, আমরা সবাই জীবনে মিথ্যের সবগ রচনা করে রেখেচি, উনিশ না হয় বিশ। মিথ্যে বলে যদি ওই দরিদ্র, অসহায় পল্লীযবেককে এতটুকু আনন্দ দিতে পারি ভালই। ওর মিথ্যে সবগ আগামী জ্যৈষ্ঠ মাস পয্যন্ত অক্ষয় হোক । আজ ঘুম থেকে উঠে যখন হাটে যাই, তখন মেঘলা করে এসেচে, বেশ লাগলো । বনে বনে কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ফলে আছে, পানপাতার মত বড় বড় লতা উঠেচে গাছে গাছে— ঘন কালো বর্ষার মেঘ করেচে নৈঋত কোণে । গোপালনগর পৌছতেই রাধাবল্লভ নিয়ে গেল ওদের বাড়ি । রাধাবল্লভের স্ত্রী পাঁচী আমাদের গায়ের , মেয়ে । ছেলেবেলায় এক সঙ্গে খেলা করেচি বকুলতলায়—বিলবিলের ধারে, যুগল বোস্টমের কামরাঙা তলার পথে । ওরা জাতে জেলে । ওর বিয়ের পর ওকে আমি এই প্রথম দেখলাম বোধ হয় বাইশ-তেইশ বছর পরে। দেখে বড় স্নেহ হোল—জড় হয়ে এসে প্রণাম করল । কথাবাত্ত" খুব বিনীত, নম্নসম । একটু ভয়ে ভয়ে কথা বললে । আমি ব্রাহ্মণ, ওর বাড়িতে গিয়েচি, পাছে আমারকোনও অসম্মান হয়, এই ভয়েই তটস্হ । ওর ছেলেকে দিয়ে একটু সন্দেশ ও জল পাঠিয়ে দিলে । তাও ভয়ে ভয়ে । ভাবলে আমি খাবো কি না। নিজের হাতে সাহস করে নিয়ে আসতে পারলে না । আমি ওকে দেখিয়ে সে সন্দেশ ও জল খেলম, ওর মনে দ্বিধা ও সত্তেকাচের কোনও অবকাশ দিলাম না । ও পড়ে গিয়েছে বড় বিপদে । এর বড় মেয়ের বয়স প্রায় কুড়ি । মেয়েটি দেখতে শুনতে বড় ভাল, লেখাপড়াও শিখেচে । ওদের জাতে ভাল ছেলে বড় একটা পাওয়া যায় না— অনেক খুজে পেতে বাপে বিয়ে দিয়েছিল ওরই মধ্যে একটু আধটুশিক্ষিত একটি ছেলের সঙ্গে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে ওর ওপর বড় খারাপ ব্যবহার করে বলে, বাপ মেয়েকে আর সেখানে পাঠাতে চায় না । সে জামাই আবার বিয়ে করচে । এই সব নিয়ে গোলমাল । ওরা জেলেপাড়ার মধ্যে বাস করে, ভাল কোঠা বাড়ি, পরিকার পরিচ্ছন্ন থাকে । ওর স্বজাতিরা সেজন্যে ওদের দু-চোখ পেতে দেখতে পারে না । তার ওপর মেয়েটা নাকি সব্বদা বই পড়ে। কি সম্বনাশ ! জেলের মেয়ে বই পড়বে কি ? ওদের পাড়ার লোক ষড়যন্ত্র করে একরাত্রে ওদের ঘরে ঢুকে কিছু টাকা কাপড়চোপড় চুরি করে নিয়ে গিয়েচে, আর এক বাক্স ভাল ভাল বই সব ছিড়ে দিয়ে গিয়েচে । পাঁচী লেখাপড়া জানে না, কিন্তু বইগুলোর শোক ওর লেগেচে খব। আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বললে—আসন তো দাদা, দেখন দিকি, আপনি তো লেখাপড়া জানেন, আমার এক বাক্স বই, খড়বশরের কেনা—বইগুলো ছিড়ে ছটে তার আর কিছু রেখেচে দাদা ? গিয়ে দেখলাম একটা আমকাঠের সিন্দকে অনেকগুলো পরোনো বই, বেশ ভাল বাঁধানো। দীনবন্ধ, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, কিছু সেকেলে বাজে বটতলার উপন্যাস, মডেলভগিনী, কঙ্কাবতী, পরোহিত দপণ ( ওদের বাড়ি পরোহিত দপণে কি কাজ জানি নে, }, রামায়ণ, হরিবংশ এই সব বই । মেয়েটা সেই সব বই পড়তো বলে পাড়ার কারও সহ্য হতো