পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দশম খণ্ড).djvu/৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বতন্ত্র। সহজত বিভূতিভূষণের ছিল নিজেকে বিকাশের পথ। কথায়, ব্যবহারে, বেশে, এই সহজতার অনুশীলন তার রচনাকে অত সহজ করেছিল। অনাড়ম্বরতা ও সহজতাই তার আর্ট। যদি তিনি আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতেন তাহলে হয়তো তার রচনার আমন সহজত নষ্ট হয়ে যেত । এখানে উল্লেখ্য, গ্রাম-ভাষ্যকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আট পৃথক ছিল । মানিকের নায়ক নায়িক সহজ পরিবেশে সাধারণ মাতুম, অতিশয় চেনা। কিন্তু তারা সহজ নয়। জটিল মানসিকতায় কখনও তারা দুজ্ঞেয়। মানিকের শহরতলী ও শহর সমস্কাজর্জরিত নাগরিক বিভ্রাস্তিবিক্ষত। বিভূতিভূষণের শহর ও শহরতলীর কোন আকস্মিক ঘাতপ্রতিঘাতে বিক্ষুব্ধ বা বিচলিত চিত্র নয়। বর্ণবজ্জিত সাদা জলের মত তাদের যেমন স্বাভাবিক রং তেমনি । এই স্থত্রে গ্রাম-বাংলার আরও এক অসাধারণ লেখকের কথা এসে পড়ে, তুলনা দ্বারা বক্তব্য পরিস্ফুট করার চিরন্তন কৌশলের মধ্যে। তাবাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। রাঢ় দেশের গ্রাম, শহর, শহরতলীকে চিত্রায়িত করেছেন তিনি। কিন্তু বিভূতিভূষণের রচনায় হৃদয় প্রধান, তারাশঙ্করের রচনায় বুদ্ধি প্রধান । 粤 তিনি দেখেছেন দ্বন্দ্ৰ—সামাজিক, শ্রেণী-বৈষম্যের । কৃষিনির্ভর সভ্যতা শিল্পনির্ভর সভ্যতায় রূপুrম্ভরিত হ’বার পথে সংঘর্ষ দেখেছেন তারাশঙ্কর, দেখেছেন জমিদারীপ্রথার ডেকাডেন্স, বা অবসাদগ্ৰস্ত বিলয় । রসের সাধনায় আত্মলোপী মাধুৰ্য্যের পথিক তিনি নন, তাই কখনও বা ঈষৎ বিশুদ্ধ। বিভিন্ন গ্রাম্য চরিত্রে অসরল ও বক্র কটাক্ষ তার সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অধিক তুলনীয় করে। নানা সমস্তার ক্ষেত্রে পদচারণও শরৎচন্দ্রকে ক্রমাগত মনে পড়ায় । তবু শহরকে ছেড়ে গ্রামের ঐশ্বর্ষ্যে দত্তমানস তারাশঙ্কর সমসাময়িক লেখক হিসাবে বিভূতিভূষণ প্রসঙ্গে তুলনীয়। e বিভূতিভূষণের গ্রাম, গ্রামবাসী, কোন মতবাদ, রাজনীতি, সমস্যা, অতি সাম্প্রতিক ঘটনার আবৰ্ত্ত ইত্যাদি দিয়ে রং-করণ নয়। স্বতরাং তাৎক্ষণিক চমক না লাগালেও চিরন্তন স্বাভাবিক গতি ও স্থায়িত্বশীলতার গুণে পলাতকা মনের আশ্রয়। নাগরিক সংঘাতের ঘূর্ণঝড়, যন্ত্রসভ্যতার নিত্যনূতন আবিষ্কার, স্পেস্বিজয়, পাণ্ডিত্যের অভিনব অবদানের মধ্যে এখনও আমরা বিভূতিভূষণের রচনায় শাস্তি খুঁজে পাই। তুচ্ছ নিয়ে বিন! আয়াসে সহজ গল্পগুলি, সাধারণ মানুষ নিয়ে স্বচ্ছন্স উপন্যাসগুলির কোন কোন খানি মহৎ সাহিত্যের সঠিক আখ্যায় চিহ্নিত—বলা শক্ত। কিন্তু যে অপরিসীম আনন্দ স্রষ্টার মনে, সে আনন্দ তিনি বিলিয়ে গেছেন প্রত্যেকটি রচনায়। অতি তুচ্ছ, অতি সামান্য নিয়ে, বিনা কারণে, শুধু বেঁচে থাকার যে আনন্দ ( উদাহরণ : ‘উৎকর্ণ’ ‘তৃণাঞ্জুর' ) সে আনন্দ শিখে নিতে চাই আমরা। যখন বাইরের বস্তুপুঞ্জ, জীবনের বান্ত্রিক কৃত্রিমতা, সভ্যতার আড়ম্বর, আমাদের জীবনকে লিম্বাদ করে তোলে, তখন বিভূতিভূষণে ফিরে বাই। কেন না তুচ্ছকে নিয়ে যে অনিৰ্ব্বচনীয়, অপরিসীম আনন্দ তাই আমরা উপলব্ধির আস্বাদে