পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ এ ধরণের কষ্ট করিতে অপু কখনও অভ্যস্ত নয়। বাড়ির এক ছেলে, চিরকাল বাপ-মায়ের আদরে কাটাইয়াছে। শহরে বড়লোকের বাড়িতে অন্ত কষ্ট থাকিলেও খাওয়ার কষ্টট অন্ততঃ ছিল না। তাছাড়া সেখানে মাথার উপর ছিল মা, সকল আপদবিপদে সর্বজয়া ডান মেলিয়া ছেলেকে আড়াল করিয়া রাথিতে প্রাণপণ করিত, কোনও কিছু আঁচ লাগিতে দিত না । দেওয়ানপুরে স্কলারশিপের টাকায় বালক-বুদ্ধিতে যথেষ্ট শৌখিনতা করিয়াছে—খাইয়াছে, খাওয়াইয়াছে, ভাল ভাল জামা কাপড় পরিয়াছে,—তখন সে সব জিনিস সস্তাও ছিল। কিন্তু শীঘ্রই অপু বুঝিল—কলিকাতা দেওয়ানপুর নয়। এখানে কেহ কাহাকেও পৌছে না । ইউরোপে যুদ্ধ বাধিয়া গত কয়েক মাসের মধ্যে কাপড়ের দাম এত চড়িয়াছে যে, কাপড় আর কেনা যায় না! ভাল কাপড় তাহার মোটে আছে একখানা, একটি টুইল শার্ট সম্বল। ছেলেবেলা হইতেই ময়লা কাপড় পরিতে সে ভালবাসে না, দু-তিনদিন অন্তর সাবান দিয়া কাপড় কাচিয়া শুকাইলে, তবে তাহাই পরিয়া বাহির হইতে পারে। সবদিন কাপড় ঠিক সময়ে শুকায় না, কাপড় কাচিবার পরিশ্রমে এক-একদিন আবার ক্ষুধা এত বেশী পায় যে, মাত্র দু’পয়সার খাবারে কিছুই হয় না—ক্লাসে লেকচার শুনিতে বসিয়া মাথা যেন হঠাৎ শোলার মত হালকা বোধ হয় । এদিকে থাকার কষ্টও খুব। সুরেশ্বর এম-এ পরীক্ষা দিয়া বাডি চলিয়া গিয়াছে, তাহার মেসে আর থাকিবার সুবিধা নাই। যাইবার আগে সুরেশ্বর একটা ঔষধের কারখানার উপরে একটা ছোট ঘরে তাহার থাকিবার স্থান ঠিক করিয়া দিয়া গিয়াছে। ঐ কারখানায় সুরেশ্বরের জানাশোনা একজন লোক কাজ করে ও রাত্রে ওপরের ঘরটাতে থাকে। ঠিক হইয়াছে, যতদিন কিছু একটা সুবিধা না হইতেছে, ততদিন অপু ওই ঘরটাতে লোকটার সঙ্গে থাকিবে। ঘরট একে ছোট, তাহার উপর অর্ধেকট ভর্তি ঔষধ-বোঝাই প্যাকবাক্সে। রাশিরুত জঞ্জাল বাক্সগুলির পিছনে জমানো, কেমন একটা গন্ধ! নেংটি ইদুরের উংপাতে কাপড়চোপড় রাখিবার জো নাই, অপুর একমাত্র টুইল শার্টটার দু জায়গায় কাটিয়া ফুট। করিয়া দিয়াছে রাত্রে ঘরময় আরসোলার উৎপাত । ঘরের সে লোকটা যেমন নোংরা তেমনই তামাকপ্রিয়, রাত্রে উঠিয়া অন্ততঃ তিনবার তামাক সাজিয়া খায়। তাহার কাশির শব্দে ঘুম হওয়া দায়। ঘরের কোণে তামাকের গুল রাশিরুত করিয়া রাখিয়া দেয়। অপু নিজে বার দুই পরিষ্কার করিয়াছিল। এক টুকরা রবারের ফিতার মতই ঘরের নোংরামিট স্থিতিস্থাপক—পূর্বাবস্থায় ফিরিতে এতটুকু দেরি হয় না। খাওয়া-পর-থাকিবার কষ্ট অপু কখনও করে নাই, বিশেষ করিয়া একল যুঝিতে হইতেছে বলিয়া কষ্ট আরও বেশী । অন্তমনষ্কভাবে যাইতে যাইতে সে কৃষ্ণদাস পালের মূর্তির মোড়ে আসিল। যুদ্ধের নূতন খবর বাহির হইয়াছে বলিয়া কাগজওয়ালা হাকিতেছে। শেয়ালদার একটা ট্রাম হইতে লোকজন নাম-উঠা করিতেছে। একটি চোখে-চশমা ভরণ যুবকের দিকে একবার চাহিয়াই