পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

هلهلا কাহিনী। এর বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে শৈল্পিক ঐক্যহুত্রে গেঁথে তুলেছে এই মানব সন্ধানের প্রেরণী—এই একটিমাত্র কেন্দ্রীয় উদ্বেগুকে ঘিরেই বিভূতিভূষণের পখিক-জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা আবর্তিত হয়েছে । তাই এ গ্রন্থের প্রতি পৃষ্ঠায় এত মানুষের ভিড়। কত বৈচিত্র্য তাদের জীবনযাত্র-পদ্ধতিতে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, আশা-আকাঙ্ক্ষায় । জাদিপাড়া গ্রামের সেই দরিদ্র গুরুমহাশয়, বাগানগা থেকে ফিরবার পথে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই কাঠ-কুড়ানী বুড়ী, বরিশালের কুপ্রবাবু, আরাকান-ইরোমার পথের সহযাত্রী প্রণয়-পাগল ডাক-পিয়াদ, বাড়বাকুণ্ডের পাওঠাকুর, আওরেংজেবপুরের অতিথিবৎসল মুসলমান গৃহস্থেরা ও বৃদ্ধ খালাসী আবদুল, আগরতলার ছন্নছাড়া কপৰ্দকহীন ভূতাত্ত্বিক, নোয়াখালির সদানন উদারহৃদয় উকিলবাবু, নরসিংদি স্কুলের ‘বনগায়ে শিয়াল-রাজা’ হেডমাস্টার মহাশয় ও দারিদ্র্যপীড়িত ড্রয়িং মাস্টার, খয়শূঙ্গ আশ্রমের সন্ন্যাসিনী মাজী, রামজীর মন্দিরের বুদ্ধ মোহাস্ত, মহিষ্কারডি গ্রামের হরবংশ গোপ, দারকেশার সমাজ-সংস্কারক মাধোলাল—ছোট বড় কত চরিত্রের আনাগোনা ‘অভিযাক্সিক’-এর পাতায় পাতায় । দোষে গুণে এরা প্রত্যেকেই এক একটি গোট মাহষ—এক একটি অনাবিষ্কৃত জগৎ —‘অভিযাত্রিক-এ প্রকৃতি বারংবার আবির্ভূত হয়েছে—অনেক সময় রূপে বর্ণে গন্ধে স্বসমৃদ্ধ হয়েই আবির্ভূত হয়েছে, কিন্তু তবু আমার মনে হয় এ গ্রন্থে প্রকৃতির চেয়ে মানবের মহিমা অনেক বেশি। প্রকৃতিবর্ণনা বর্জন করলে এর অনেকখানি যাবে সত্য, কিন্তু মাছুষের কথা বাদ দিলে কিছুই থাকবে না। এই সব মানুষকে বিভূতিভূষণ দেখেছেন প্রতির দৃষ্টিতে, সহানুভূতির দৃষ্টিতে, কখনও কখনও ঈষৎ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে। এদের মনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসবার চেষ্টা করেছেন তিনি, গোপন চিন্তা ও অহঙ্কৃতির চোরাকুঠুরির চাবিকাঠি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন ; কখনও বা তা করতে পেরেছেন, কখনও পারেন নি। কিন্তু এদের সবার কাছ থেকেই তিনি কিছু না কিছু পেয়েছেন–র্তার জীবনবোধের পরিপুষ্ট সাধনে এরা সকলেই কিছু না কিছু সাহায্য করেছে —‘মানুষকে জেনে চিনে লাভই হয়েচে, ক্ষতি হয় নি, একথা আমি মুক্তকণ্ঠে বলবো।’ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর মনেধর্মের সঙ্গে বিভূতিভূষণের মনেধর্মের সাদৃপ্ত অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। শুধু প্রকৃতির ক্ষেত্রে নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও এই সাদৃপ্ত বর্তমান। ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর মত বিভূতিভূষণেরও মানবদৃষ্টি আংশিক—কিছু পরিমাণে পক্ষপাতদুষ্টও বটে। মুশিক্ষিত, সুসংস্কৃত, বিত্তবান শহুরে মানুষের প্রতি র্তার একটা স্বাভাবিক ঔদাসীন্য ছিল। ভ্ৰাম্যমাণ জীবনে এদের সংস্পর্শ তিনি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। সাধারণ গ্রাম্য মানুষ, দরিদ্র বা স্বল্পবিত্ত মানুষ, অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষ, নিরীহ ধর্মভীরু সরলপ্রাণ মানুষ—‘অভিযাত্রিক’-এর চরিত্রচিত্রশালায় এদেরই ভিড় বেশি। যে দুই একটি ব্যতিক্রম দেখা যায়—যেমন বরিশালের সেই শেক্সপীয়র-পাগল ভদ্রলোকটি অথবা নোয়াখালির উকিলবাবুট—ষ্ঠারাও তাদের সহজ সারল্যের গুণেই শুধু এদের মধ্যে ঠাই পেয়েছেন।