পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩e বিভূতি-রচনাবলী আমি ওখান থেকে চলে গেলাম সীতাবলডির বাঞ্জারে ঘড়ির দোকানে। সেখানে রেডিওতে কলকাতা Short Wave ধরেচে, বাংলা গান বাজচে—একটু পরে রেডিও স্টেশনের বিষ্ণু শৰ্মা সুপরিচিত গলায় কি একটা গানের ঘোষণা করলে। মনে মনে ভেবে দেখলাম কত পাহাড় জঙ্গল পার হয়ে ৭৫০ মাইলের ব্যবধান ঘুচিয়ে বিষ্ণু শৰ্মার গলা এখানে এসে পৌঁছলো—যে মুহূর্তে সে গাষ্টিন প্লেসের সেই রাঙা বনাত মোড় ঘরটায় বসে একথা বললে সেই মুহূর্তেই। রেডিওর অভূতত্ব এভাবে কখনো অনুভব করি নি—কলকাতায় বসে শুনলে এর গভীর বিস্ময়ের দিকটা বড় একটা মনে আসে না। তারপর টাঙা নিয়ে নেরুলকরের ওখানে গেলাম। ডাক্তার বেরিয়ে গিয়েচে–বসে বসে “The Story of the Mount Everest' বইখানা পড়লাম-রাত দশটা বাজে, এখনও ডাক্তার এল না। আমি একটা চিঠিতে লিখে এলাম, কাল সকলে দুবেকে সঙ্গে নিয়ে যেন নেরুলকর আমাদের ওখানে আসে। তারপর একটা টাঙা নিয়ে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত স্টেশন দিয়ে ফিরলাম । সকালে গীতবিলডির ঘড়ির দোকানে ঘড়ি সারাতে গেলাম—ওখান থেকে গেলাম ডা: নেরুলকরের ওখানে ও স্টেশনে বার্থ রিজার্ভ করতে। দুপুরে মিউজিয়ামে গিয়ে গোড় জাতির অস্বশস্থ, বালাঘাট পার্বত্যদেশের খনিজ প্রস্তর, fossil, জব্বলপুরের অধুনালুপ্ত অতিকায় হস্তী, নর্মদার উত্তরে অরণ্যের অধুনালুপ্ত সিংহ, বনবিড়াল, ঝিন ওয়ার জঙ্গলের বাইসন বা সৌর— কত কি দেখলাম। খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতকের চেদীরানী লোহলের প্রস্তরলিপি ও বৌদ্ধ রাজা স্বর্য ঘোষের পুত্র রাজপ্রসাদের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার ফলে মারা যাওয়াতে ভগবান তথ্যগতের উদ্দেশে পুত্রের আত্মার সদগতির জন্ত তিনি যে মন্দির নির্মাণ করেন—সে লিপিটিও পড়লাম । আজ খুব রোদ, আকাশ খুব নীল, বাংলোর বারানায় বসে লিখচি। এখনি চ খেতে যাব। তারপর আমরা রওনা হলুম। ডাঃ নেরুলকর স্টেশনে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেলেন। ডুগ ও ডোঙ্গরগড়ের মধ্যবর্তী বিখ্যাত সালাকেস ফরেস্ট দেখব বলে আমরা রাত দেড়টা পর্যন্ত জেগে বসে রইলাম। নাগপুর ছড়িয়ে ছোট ছোট শালের জঙ্গল অনেক দেখা গেলজ্যোৎস্না রাত্রে প্রকাও অরণ্যটার রূপ আমার মনে এমন এক গম্ভীর অনুভূতি জাগালে—সে রাত্রে ঘুম আমার আর এল না—ডোঙ্গরগড় স্টেশনে গাড়ি এসে পড়ল, রাত তিনটে বেজে গেল, ঘুমুবার ইচ্ছেও হল না—জানাল থেকে চোখ সরিয়ে নিতে মন আর সরে না। নাগপুর থেকে ফিরেই দেশে গিয়েছিলাম। ইছামতী দিয়ে নৌকোতে বিকেলের দিকে গ্রামের ঘাটে পৌঁছলাম—বালে একটা কি ছেলেদের কাগজে একটা কবিতা পড়েছিলাম— ঘাটের বাটে লাগল যবে আমার ছোট ভর, ঘনিয়ে আসে ধরায় তখন শীতের বিভােবরী।’ এতকাল পরে সেই দুটি চরণই বার বার মনে আসতে লাগল। মাধবপুরের মাঠে স্বর্য অন্ত গেল, চালতেপোতার বাকের সবুজ ঝোপঝাপ দেখলাম-এবার কিন্তু চোখে লাগল না তেমন । কেন এমন হল কি জানি ?