পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\0> e বিভূতি-রচনাবলী তাহাদের বাড়ির মনে প্রকাণ্ড মাঠ গঙ্গার কিনারা পর্যন্ত সবুজ ঘাসে ভরা, তারপরেই খাড়া পাড় নামির গিয়া জল ছুইয়াছে। জল সেখানে অগভীর, চওড়াতেও হাত দশ বারে মাত্র, পরেই গঙ্গার বড় চরাটা । সারাবছরেই চরায় জলচর পক্ষীর বর্ণক চরিয়া বেড়ায় । চরার বাহিরের গভীর বড় গঙ্গার দিকে না গিয়া তারা গঙ্গার এই ছোট অপরিসর অংশট ঘেষিয়া থাকে । কণ্টিকারীর বনে চরার বালি প্রায় ঢাকিয়া ফেলিয়াছে, বারো মাস বেগুনী ফুল ফুটিয়া নির্জন বালির চর আলো করিয়া রাখে। মাঠে কোনো গাছপালা নাই ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠের মত সমতল ও তৃণাবৃত ; দক্ষিণে ও বারে একদিকে বড় রেলওয়ে-বাঁধটা ও অন্যদিকে দূরবর্তী গ্রামসীমার বনরেখার কোল পর্যন্ত বিস্তৃত। দুই এক সারি তালগাছ এখানে ওখানে ছাড়া এই বড় মাঠটাতে অন্ত কোনো গাছ চোপে পড়ে না কোনো দিকে । এই বিশাল মাঠে প্রতিদিন সকাল হয়, স্বর্য মাঝ-আকাশে দুপুরে আগুন ছড়ায়, বেলা ঢলিয়া বৈকাল নামিয়া আসে, গোধূলিতে পশ্চিম দিক কত কি রঙে রঞ্জিত হয়। চাদ ওঠে —সারা মাঠ চর, রেলওয়ে বাধ, ও-পাশের বড় গঙ্গাট জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হইয়া যায়। কিন্তু কখনও কোনো কালে রাঘব চক্রবর্তী বা তাহার প্রতিবেশীরা এই সুন্দর পল্লীপ্রাস্তরের প্রকৃতির লীলার মধ্যে কোনো দেবতার পুণ্য আবির্ভাব কল্পনা করেন নাই, প্রয়োজন বোধও করেন নাই—সেখানে আজ সর্বপ্রথম এই নিরক্ষরা বিকৃত-মস্তিষ্ক গ্রাম্যবধূট বৈদিক-যুগের মন্ত্রদ্রষ্টা বিদুষীর মত মনে প্রাণে খুঁটি-দেবতার আবাহন করিল।. আমি এই মাঠেই বৈকালে দাড়াইয়৷ কথাটা ভাবিতেছিলাম। কথাটার গভীরতা সেদিন সেখানে যতটা উপলব্ধি করিয়াছিলাম, এমন আর বোধহয় কোথাও করিব না । নন্দলাল স্ত্রীর অবস্থা দেখিয়া বড় বিব্রত হইয়া পড়িল। সে স্ত্রীকে ভালবাসিত ; নানারকম ঔষধ, জড়ি বুট, শিকড়-বাকড় আনিয়া স্ত্রীকে ব্যবহার করাইল। তিরোলের পাগলী-কালীর বালা পরাইল ; যে যাহা বলে তাঁহাই করিতে লাগিল, কিন্তু কিছুতে কিছু হয় না। একটা মুফল দেখিয় সে খুশী হইল যে আজকাল স্ত্রী সকালে উঠিয়া ছাইগাদা হাতড়াইতে বসে না । তবুও সংসারের কাজকর্মগুলি কেমন অন্তমনষ্কভাবে করে, হয়তো বা তরকারী পুড়াইয়া ধরাইয়া ফেলে, নয়তো ডালে খানিকট বেশী মুন দেয়, ভাল করিয়া কথা বলে না-ইহাই রহিল তাহার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ । মাস দুই কাটিয়া গেল। শ্রাবণ মাস। বর্ষার ঢল নামিয়া বড় গঙ্গা ও ছোট গঙ্গা একাকার করিয়া দিল, চর ডুবিয়া গেল। কুলে কুলে গেরিমাটির রঙের জলে ভর্তি। এই সময় নন্দলালের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া উঠিল। হাতে পূর্বে যাহা কিছু ছিল, সবই খরচ হইয়া গিয়াছে—এদিকে চাকরিও জুটিল না। রাঘব চক্রবর্তী ভাগিনেয়কে খুঁটিনাটি লইয়া বকুনি শুরু করিলেন। ভাগিনেয়কে ডাকিয়া বলিলেন-কোনো কিছু একটা দেখে নিতে তো পারলে না। তা দিনকতক এখন না হয় বউমাকে বাপের বাড়ি রেখে তুমি কলকাতার দিকে গিয়ে কাজকর্মের ভালো করে চেষ্টা করে, নইলে আমি আর কি করে চালাই বলে। এই তো দেখছে অবস্থা—ইত্যাদি।