পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©öly বিভূতি-রচনাবলী রেলে কোথায় যাওয়া যায় বেশ ভেবেচিন্তে দেখলুম। দূরে কোথাও যাওয়া চলবে না, তত পয়সা নেই হাতে। সুতরাং আমি পরামর্শ দিলাম, মার্টিনের ছোট রেলে চলো কোথাও যাওয়া যাক। সে বেশ নতুন জিনিস হবে এখন। হাওড়া ময়দান স্টেশনে ছোট লাইনে চেপে আমরা জাঙ্গিপাড়া কৃষ্ণনগরে রওনা হলুম। দুধারে যখন পড়লো ফাকা মাঠ আর বঁাশবন, আমবন—আমাদের মন যেন মুক্তির আনন্দে নেচে উঠলো । বেলা তিনটের সময় আমরা নামলুম গিয়ে জাঙ্গিপাড়া। দুজনে গ্রামের মধ্যে ঢুকলুম—বড় বড় বাশবন ঝোপঝাড় আর ছোটবড় পানাপুকুর চারিধারে। বেলা তিনটের মধ্যে এমন ছায়া নেমে এসেচে যেন এখনি সন্ধ্যা হবে হবে। আমরা একটা ময়রার দোকানে বসলুম—ময়রার সম্বল কালো দড়ির জলের পেছনে কলঙ্ক-ধরা পেতলের থালায় সাজানো চিনির ডেলা সন্দেশ, তেলে ভাজা বাসি জিলিপি, কুচো গজা, চিড়ে মুড়কি আর বাতাসা। কলকাতার বাবু দেখে ময়রা খাতির করে বসালে। নীরদ ইংরিজিতে বললে—যেরকম খাতির করলে এরপর নিতান্ত মুড়কি তো কেনা যায় না—উপায় কি ? —এসো একটু চাল দেয়া যাক--তুমিই আরম্ভ করো। ময়রাকে ডেকে নীরদ বললে—ওহে, ভালো সন্দেশ আছে ? ময়র করুণদৃষ্টিতে চিনির ডেল সন্দেশের থালার দিকে চেয়ে বললে—আজ্ঞে খুব ভালো হবে না। একটু চিনি বেশি হবে—আপনাদের তা দেওয়া যায় না। আমি চুপি চুপি বললুম—ময়রা আমাদের কি ভেবেচে হে ? দুজনের পকেট এক করলে খাবার খাওয়ার বাজেট কত ? নীরদ উত্তর দিলে—সাত পয়সা । তার মধ্যে একটা পয়সা পান খাওয়ার জন্তে রাখে— ছ’পয়সা । আমি তখন তাচ্ছিল্যের মুরে বললুম-চিড়ে মুড়কিই দাও তবে ছপয়সার, ও বরং ভালো, এসব জায়গায় বাজে ঘি তেল— খেতে খেতে ময়রাকে জিজ্ঞেস করা গেল, তোমাদের এখানে এত ডোবা আর জঙ্গল, ম্যালেরিয়া আছে নকি ? ময়রা আমাদের জন্তে তামাক সাজতে সাজতে বললে—ম্যালেরিয়ায় উচ্ছন্ন গেল সব বাবু, আর আপনি বলেন আছে নাকি ? ভেতরে ঢুকে দেখুন কি অবস্থা গায়ের। বেলা পড়ে এলে আমরা গ্রামের মধ্যে ঢুকলুম। বাংলায় ম্যালেরিয়া-বিধ্বস্ত দরিদ্র গ্রামের এমন একখানি ছবি সেই আসন্ন হেমন্তসন্ধ্যায় য়েদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যা চিরদিন আমার মনে আঁকা রয়ে গেল। ছবি নিরাশার, দুঃখের, অপরিসীম নিঃসঙ্গতার ও একান্ত দারিত্র্যের । সেই বনজঙ্গলে ভরা গ্রামখানির ওপর ধ্বংসের দেবতা যেন উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, তার করাল কালো ডানার ছায়ায় সারা গ্রাম অন্ধকার ।