পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\og বিভূতি-রচনাবলী আমি বিপদে পড়লুম, মেয়েদের কাছে বাজে কথা বলি কি করে ? কিন্তু ভগবান আমার সে-বার দায় থেকে মুক্ত করলেন ;পাণ্ডাঠাকুরের স্ত্রী এসেই আমাকে বললে, আপনি যদি কাল কুমারী পূজো করেন তবে আমার বলবেন, আমি যোগাড় করে রেখে দিয়েচি দুজনকে। আমি বললুম, কাল আমি বাড়িয়াডাল যাবে, ওদিকের পাহাড় আর জঙ্গলগুলো দেখে আসি, কাল আমার দরকার হবে না। এদের আমার বড় ভালো লেগেছিল। অত্যন্ত সরল এরা, যা বলেচি, সব এরা বিশ্বাস করে নিয়ে খুশী হয়ে উঠেচে। প্রতিদিন বেলা পড়লে আমি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের তলায় একটি ঝরনার ধারে বেড়াতে যেতুম। সন্ধ্যাবেলায় স্থানটি একটি অপরূপ শ্ৰী ধারণ করতো। গাছপালার শুামলতা, বনকুসুমের শোভা, সম্মুখের শৈলশ্রেণীর গভীর উন্নত সৌন্দর্য, বনের পাখীর ডাক, ঝরণার কুলু কুলু শব—আর সকলের ওপরে স্থানটির নিবিড় নির্জনতা আমাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় টেনে নিরে যেতো সেখানটিতে । চুপ করে বসে থাকবার মতো জায়গা বটে। দুঘণ্টা বসে থেকেও আমার যেন তৃপ্তি হত না । সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক পর পর্যন্ত, ঝরনাটার ওপরে একটা ছোট কাঠের পুল আছে সেখানে বসে থাকতুম। কোনো স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবার একটি বিশেষ টেকনিক আছে। আমার জীবনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দ্বারা আমি সে টেকনিক অর্জন করেচি, তাতে হয়তো অপরের উপকার নাও হতে পারে। আমার মনে হয় প্রত্যেক প্রকৃতি-রসিক ব্যক্তি অভিজ্ঞতার দ্বারা নিজের টেকনিক নিজেই আবিষ্কার করেন। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের যেতে হয় একাকী, তবেই প্রকৃতি-রানী অবগুণ্ঠন উন্মোচন করেন দর্শকের সামনে, নতুবা নয়। চুপ করে বসে থাকতে হয়, একমনে ভাবতে হয়, মাঝে মাঝে চারিদিকে চেয়ে দেখলে মনে আপনিই কত ভাবনা এসে পড়ে। সে সব চিন্তার সঙ্গে কখনোই পরিচয় ঘটে না লোকালয়ের ভিড়ে। এমন কি, সঙ্গে কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকলেও প্রকৃতির সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় না । সন্ধ্যার পরে অস্পষ্ট মেটে জোৎস্না উঠে সে বনপর্বতের শোভা শতগুণ বাড়িয়ে তুলতে, কি একটা বনফুলের সুবাস ছড়াতে বাতাসে, মনে হত সমগ্র পৃথিবীতে আমি ছাড়া যেন আর দ্বিতীয় মায়ং নেই, সমস্ত পৃথিবী আমার, গোটা তারাভর আকাশটা আমার। অলস স্বপ্নাতুর মনের অবকাশ-ভরা এক-একটি দিন, এক-একটি জ্যোৎস্নালোকিত সন্ধ্যা, যেন সহস্ৰ সহস্ৰ বর্ষজীবী কোনো দেবতার জীবনে এক-একটি পল বিপল। অন্ত সময়ে সেখানে কখনো যাইনি, যেভূম રુ সন্ধ্যাবেলা—যখন সে পথে লোক চলাফের করতে না, মাছুষজনের কণ্ঠস্বর কোনোদিকে শোনা যেতো না। একদিন সেখানে বসে আছি, এমন সমরে পথের দিকে কাদের কথাবার্তা শোনা গেল।